সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে মানবকঙ্কাল পাচার চক্রের সন্ধান মিলেছে, যা আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কবরস্থান থেকে কঙ্কাল চুরি করে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে, এমন খবর শুধু ভয়ংকর নয়, বরং এটি জঘন্য অপরাধ, যা ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতি এবং আইনের চরম লঙ্ঘন।
রূপালী বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিবেদনে জানা যায়, কঙ্কাল চুরি করে বিদেশে পাচার করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। যে চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে মেডিকেল কলেজের কিছু শিক্ষার্থী, মর্গের ডোম, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের কয়েকজন অসাধু মালিক আর সীমান্তের কিছু চোরাকারবারি। বিভিন্ন সময়ে পুলিশের নানা অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে চক্রের সক্রিয় সদস্যদের, তবুও থামছে না এ কারবার।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোলায় রাতের আঁধারে পাঁচটি কবর খুঁড়ে দুই নারীর লাশ চুরির ঘটনা ঘটে। জেলার দৌলতখান উপজেলার উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের মধ্যজয়নগর গ্রামের কামাল পাটোয়ারীবাড়ি জামে মসজিদের পাশে মকবুল হাজিবাড়ি ও মীরাবাড়ির যৌথ কবরস্থান থেকে লাশগুলো চুরি করা হয়। শুধু ভোলা নয় দেশের নানা স্থানে কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটছে। বরিশাল, শেরপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহের ভালুকা, দিনাজপুর সদরের সুন্দরবন ইউনিয়ন, সিরাজগঞ্জের নাইমুড়ি গ্রাম, সাভারের আশুলিয়ায় গত পাঁচ বছরে অন্তত তিন হাজারের বেশি কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটেছে।
চক্রগুলো কঙ্কাল চুরির আগে নির্দিষ্ট স্থান রেকি করে নেয়। এ ছাড়া কঙ্কাল চোর-চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে মাদকাসক্তরাও। সাধারণত এদের এসব অপকর্মে ব্যবহার করা হয়।
এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার জন্য কেবল কিছু অসাধু ব্যক্তি নয়, বরং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গাফিলতি ও নজরদারির অভাবও দায়ী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় কবরস্থানে পাহারাদার নেই, নিরাপত্তা নেই, এমনকি সন্ধ্যার পর আলো পর্যন্ত থাকে না। এই সুযোগে কবর খুঁড়ে মানবদেহের হাড়গোড় চুরি করে পাচারকারীরা। বিশেষত চিকিৎসা সরঞ্জাম, অবৈধ গবেষণাগার কিংবা কালো জাদুর মতো অনৈতিক কাজে এসব কঙ্কাল ব্যবহারের চাহিদা থেকেই এ চক্র সক্রিয়।
মানবকঙ্কাল পাচার শুধু একটি অপরাধই নয়, এটি মৃত মানুষের প্রতি চরম অবমাননা। ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মেও মৃতের মর্যাদা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মৃতদেহের এহেন অপমান ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এবং সমাজে চরম অসন্তোষ তৈরি করে।
ধর্মীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন, কবরের সঙ্গে মানুষের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। কেউই চান না তার স্বজনের লাশ কবর থেকে চুরি হয়ে যাক। বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির লাশ চুরির বিষয়ে স্বজনরা অতিরিক্ত আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। নানা অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির লাশ চুরির ক্ষেত্রে চোর চক্রের বাড়তি তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। চিকিৎসাবিষয়ক শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে মানুষের কঙ্কালের চাহিদা রয়েছে এবং তা সংগ্রহের বৈধ কিছু নিয়মও রয়েছে।
সরকারের উচিত এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করা। কবরস্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ এবং রাত্রীকালীন টহলের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, পাচার চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সীমান্ত দিয়ে কঙ্কাল পাচার ঠেকাতে কাস্টমস ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে আরও সক্রিয় করতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিদেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। মৃতের প্রতি সম্মান ও মানবিকতার জন্য আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
আমরা মনে করি, মানবকঙ্কাল পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিলে ভবিষ্যতে এই ঘৃণ্য অপরাধ আরও বিস্তৃতি লাভ করবে। যা আমাদের নৈতিকতা ও মানবিক সমাজের ভিত্তিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।