বর্তমান সময়ে দেশের জনগণ সবচেয়ে বেশি ভুগছে লাগামহীন মূল্যস্ফীতিতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। চাল, ডাল, তেল, আটা, সবজি থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য ও ওষুধ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল্যবৃদ্ধি যেন নির্ধারিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনধারায় এক ধরনের অস্থিরতা ও উদ্বেগ জন্ম দিয়েছে এই দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতি।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই এ মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি জানান, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর নীতিমালা গ্রহণে বাধ্য করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসেও দেশে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে, যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, রূপান্তরিত বাজার ব্যবস্থার দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি-নির্ভরতা, চোরাকারবার ও বাজার সিন্ডিকেটের কারণে এই সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমেই বাজার নজরদারি জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টাস্কফোর্স ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা জরুরি।
পাশাপাশি, উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রণোদনা ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলে খাদ্যপণ্যের সংকট বাড়বে এবং বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো, বিশেষ করে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি।
মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয় করেও মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। বাজারে অতিরিক্ত মুদ্রার প্রবাহ কমিয়ে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরানো দরকার।
এটা স্পষ্ট যে, দেশে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর লোভ এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা প্রয়োজন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দিনমজুর, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নি¤œ-আয়ের মানুষ সংকটে দিনযাপন করছে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের দিকে নজর দিতে হবে। ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও সম্প্রসারণ এবং ভর্তুকি প্রক্রিয়ার সঠিক বাস্তবায়ন করলে মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।
আমরা আশা করব মূল্যস্ফীতির শৃঙ্খল ভাঙতে সরকার এখনই কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তা না হলে সামাজিক অস্থিরতা, আয় বৈষম্য ও দারিদ্র্য আরও বেড়ে যাবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ব্যাহত করবে নিঃসন্দেহে।