সমাজবদ্ধ জীবনে পরস্পরে দ্বন্দ্ব হওয়াটা স্বাভাবিক। সঙ্গে সঙ্গে সেই দ্বন্দ্ব নিরসনের পন্থা থাকাটাও জরুরি। সব সমাজেই এটা আছে। তবে ইসলামি সমাজে সন্ধি ও সমঝোতার প্রতি সর্বাধিক তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ষষ্ঠ হিজরিতে রাসুল (সা.) সাহাবিদের নিয়ে ওমরাহ পালন করতে মক্কায় রওনা হয়েছিলেন। মক্কার অদূরে পৌত্তলিক কুরাইশদের বাধার মুখে সন্ধি করে ফিরে আসেন, যা ইতিহাসে ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। বাহ্যত এটিকে পরাজয় মনে হলেও মহান আল্লাহ একে ‘প্রকাশ্য বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমনÑ আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়। (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ১)।
আসলে হয়েছেও তা-ই। হুদাইবিয়ার সন্ধিই মক্কা বিজয়ের পথ সুগম করে। এভাবেই রাসুল (সা.) সংঘাত পরিহার করে সমঝোতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
দাউদ (আ.) ও সুলাইমান (আ.)-এর একটি ঘটনা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘এবং স্মরণ করো দাউদ ও সুলাইমানের কথা, যখন তারা বিচার করছিল শস্যখেত সম্পর্কে; তাতে রাত্রিকালে প্রবেশ করেছিল কোনো সম্প্রদায়ের মেষ; আমি প্রত্যক্ষ করছিলাম তাদের বিচার। এবং আমি সুলাইমানকে এ বিষয়ের মীমাংসা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান। আমি পর্বত ও বিহঙ্গকুলকে অধীন করে দিয়েছিলাম, তারা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করত; আমিই ছিলাম এই সময়ের কর্তা।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৭৮-৭৯)।
আয়াতে বর্ণিত বিষয়টি হলো- দুজন ব্যক্তি দাউদ (আ.)-এর কাছে উপস্থিত হয়। তাদের একজন মেষের মালিক এবং অন্যজন শস্যখেতের মালিক।
শস্যখেতের মালিক মেষের মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল, মেষযূথ রাতে তার শস্য নষ্ট করে দিয়েছে। মেষযূথের মূল্য বিনষ্ট শস্যখেতের সমান ছিল।
দাউদ (আ.) রায় দিলেন যে মেষযূথের মালিক তার সব মেষ শস্যখেতের মালিককে অর্পণ করবে। রায় নিয়ে বাদী ও বিবাদী দাউদ (আ.)-এর আদালত থেকে বের হলে দরজায় দাউদ (আ.)-এর পুত্র সুলাইমান (আ.)-এর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তিনি তাদের কাছ থেকে রায়ের আদ্যোপান্ত শোনেন। অতঃপর সুলাইমান (আ.) বলেন, ‘আমি রায় দিলে এর চেয়ে উত্তম হতো এবং উভয়পক্ষ উপকৃত হতো।’ তারপর তিনি পিতাকে বিষয়টি জানালেন, আপনি মেষযূথ শস্যখেতের মালিককে দিয়ে দিন। সে এগুলোর দুধ ও পশম দ্বারা উপকৃত হোক। আর ক্ষেত মেষযূথের মালিককে দিয়ে দিন, সে তাতে চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদন করুক। যখন শস্যখেত মেষযূথের বিনষ্ট করার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে তখন শস্যখেত খেতের মালিককে আর মেষযূধ মেষযূথের মালিককে ফেরত দিন। দাউদ (আ.) খুশি হয়ে উভয়পক্ষকে ডেকে তা কার্যকর করেন। এভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলো। সবাই খুশি হলো।
ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমান সাহাবায়ে কেরাম সব সময় সংঘাত এড়িয়ে সমঝোতা করার পক্ষে ছিলেন।
সাহল বিন সাদ (রা.) বলেন, কোবাবাসী বনু আমর বিন আওফ-এর (মুসলমানরা) পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত হলো। একপর্যায়ে তারা পরস্পরের প্রতি পাথর নিক্ষেপ শুরু করল। খবর পেয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) সবাইকে বললেন, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে চলো। আমরা তাদের মধ্যে সন্ধি করে দেব।’ (বুখারি, হাদিস : ২৬৯৩)।
অতঃপর তিনি গেলেন এবং তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিলেন। অতঃপর ফিরে এলেন। তাতে সালাত ফউত (সময় শেষ) হওয়ার উপক্রম হলো। তখন মুসল্লিরা আবু বকরকে ইমামতির জন্য এগিয়ে দিল।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৮৪)।
সন্ধি ছাড়া সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর সন্ধির জন্য উভয়পক্ষের আন্তরিকতা থাকা আবশ্যক।