ছাত্র রাজনীতি মানেই ইতিহাস। ছাত্ররাই এক সময় এ দেশের গণতন্ত্রের সূচনা করেছে, স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, ভাষার অধিকার রক্ষায় রক্ত দিয়েছে, এমনকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাও হয়েছে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে পতিত শেখা হাসিনার দেড় দশকের স্বৈরশাসনের অবসান হলো এটাও ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই। ছাত্র রাজনীতি তাই দেশের ইতিহাসের অন্যতম অংশ। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তা, গণতন্ত্র ও জাতীয় আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা ছাত্র রাজনীতির পীঠস্থান। এর হলগুলো, এর রাজনীতি, এর ছাত্রসমাজ, সবকিছু যেন সে গর্বের প্রতিফলন।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮টি হলে ছাত্রদলের হল কমিটি প্রকাশ নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল দলীয় রাজনীতির নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক শিক্ষার পরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রশ্নও সামনে এনেছে। শিক্ষার্থীদের একাংশের অভিযোগ। এই কমিটিগুলোর অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা, ছিনতাই, মারধরসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের অভিযোগ। এমনকি কয়েকজন নেতার নাম রয়েছে হত্যা মামলার আসামির তালিকায়। কারো বিরুদ্ধে রয়েছে অতীতে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও, যা এখন অস্বীকার করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন সামনে আসছে, ছাত্র রাজনীতি কি তবে এখন দলবদলকারী অপরাধীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে?
এই প্রশ্ন আরও গভীর হয়ে ওঠে যখন আমরা স্মরণ করি- ২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলন’ এর সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা একযোগে একটি প্রধান দাবি তুলেছিলেন: হলগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করা হোক। এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো রাজনীতির নামে দখলদারিত্ব, টর্চার সেল, নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিং ও সেশনজট তৈরির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তারা চেয়েছিল হলগুলো হোক নিরাপদ, পড়ালেখার অনুকূল একটি পরিবেশ, যেখানে ভিন্নমত থাকলেও তা থাকবে সহনশীলতার সীমায়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই পুরোনো দখলদার রাজনীতিই আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে। এবারের ছাত্রদল কমিটির ঘোষণায় দেখা গেছে, অনেক হল কমিটিতে যাদের দায়িত্বে আনা হয়েছে, তারা সংশ্লিষ্ট হলের বাসিন্দাও নন। আবার অনেকের বয়স প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকে ক্যাম্পাস রাজনীতির বাইরে অন্য ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত বলেও অভিযোগ আছে।
একটা সময় ছিল, যখন ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্বে আসার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হতো, সংগ্রাম করতে হতো, আদর্শের পরীক্ষা দিতে হতো। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে পেশিশক্তি, রাজনৈতিক যোগসূত্র, এবং কখনো কখনো অর্থবিত্তের প্রভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এটি এক ভয়ানক সংকেত।
এখন সময় এসেছে রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে সমন্বিতভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবার। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা নয়, কারণ একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ছাত্রদের রাজনৈতিক চর্চা থাকা উচিত। তবে সেটি হতে হবে মূল্যবোধভিত্তিক, দায়িত্বশীল, ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। অপরাধীদের কোনো ধরনের প্রশ্রয় দেওয়া, বা তাদের রাজনৈতিক ছায়ায় আশ্রয় দেওয়ার সংস্কৃতি যদি চলতেই থাকে, তাহলে ছাত্র-রাজনীতি একদিন পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, এবং তার অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়বে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক দখলদারিত্ব বন্ধ করতে হবে। কোনো দলই যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে না পারে, তাহলে সেই রাজনীতি টিকে থাকবে না। একইভাবে প্রশাসনের উচিত রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে, নীতিনিষ্ঠ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ক্যাম্পাসে যারা অপরাধে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দলীয় পরিচয় না দেখে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র। সেখানে রাজনীতি থাকবে, কিন্তু তা হবে যুক্তিবাদী, সহনশীল ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির মাধ্যম। আর সেই রাজনীতির নেতৃত্বে আসবে তারা, যারা আদর্শে বিশ্বাসী, যারা শিক্ষার্থীদের কথা বলে, এবং যারা অপরাধ থেকে দূরে থাকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, স্বার্থপর ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বদলে ছাত্রদের জন্য একটি নিরাপদ, অংশগ্রহণমূলক ও আদর্শিক রাজনৈতিক পরিম-ল গড়ে তোলার। তবেই ছাত্র রাজনীতিতে সুস্থ ধারা বজায় থাকবে। তা না হলে আগামী দিনের ছাত্র নেতৃত্ব আরও বিশৃঙ্খলার দিকে চলে যাবে। তৈরি হবে আদর্শিক শূন্যতা, যার খেসারত দিতে হবে পুরো জাতিকে।
আপনার মতামত লিখুন :