একদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি, অন্যদিকে নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে উৎসবের আবহ। এর মাঝেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ইসলামী ছাত্রশিবির যে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল, সেটি যেন একটি সুপরিকল্পিত উসকানি। এটি যতটা না প্রদর্শনী, তার চেয়েও বেশি ছিল একটি পরীক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসকে অপমান করার সাহস তারা কতদূর নিতে পারে, সেটা যাচাইয়ের চেষ্টা।
প্রদর্শনীতে তারা তুলে ধরেছে সেইসব যুদ্ধাপরাধীদের মুখ যারা জাতির ইতিহাসে চরম কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত। মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, কাদের মোল্লা কিংবা কামারুজ্জামানের নাম কোনোভাবেই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তবে সেটা গৌরবের ইতিহাসে নয়, বরং ঘৃণার অধ্যায়ে। তারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু সম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছিল।
শিবির যখন এসব যুদ্ধাপরাধীদের ‘শহিদ’ বা ‘নিরপরাধ’ হিসেবে তুলে ধরে, তখন শুধু শহিদদের রক্ত নয়, এই জাতির আত্মাও কাঁদে। বারবার এই চিত্রনাট্য আমাদের সামনে হাজির করে তারা বোঝাতে চায়, তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মেনে নেয়নি, বরং সেই ইতিহাস পাল্টে দিতে চায়।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো, এই প্রদর্শনী কি শুধু ছাত্রশিবিরের নিজস্ব উদ্যোগ ছিল? নাকি এর পেছনে ছিল প্রশাসনের নীরব সম্মতি বা প্রশ্রয়? এমন প্রশ্ন উঠছে, কারণ ঢাবির প্রাণকেন্দ্রে এমন একটি স্পর্শকাতর আয়োজন কীভাবে সম্ভব হলো? কীভাবে অনুমতি মিলল? কীভাবে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের চোখ এড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ছবির পাশে ‘শহিদ’ শব্দটি বসিয়ে একটা গোটা ইতিহাসকে গলাটিপে হত্যা করা হলো।
যারা এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করেছে, যারা এখনো তাদের ‘নায়ক’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়, তারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তিরই পুনর্জাগরণ ঘটাতে মরিয়া। ছাত্রশিবির তার ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকার’ বহন করছে ঠিকই, কিন্তু ভুলে যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ইতিহাস এদেশের জনগণের হৃদয়ে যতটা গেঁথে আছে, ততটাই তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এই ধরনের বিপরীত উদ্যোগের বিরুদ্ধে।
শিবিরের এই প্রদর্শনী মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখানোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টার আরেকটি কিস্তি। তারা তাদের অতীতকে মুছে ফেলতে পারছে না, বরং গর্বের সঙ্গেই তা বহন করছে। কিন্তু এটিই তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় বোঝা। যতবার তারা যুদ্ধাপরাধীদের ‘বীর’ বানানোর চেষ্টা করবে, ততবারই মূলধারার ছাত্রসমাজসহ গোটা জাতি তাদের আরও বেশি ঘৃণাভরে দূরে ঠেলেছে। তাদের থেকে নিজেদের আলাদা করে নেবে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো, এমনকি ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী অনেক শিক্ষার্থীও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রশাসকদেরও প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। তারা কীভাবে এমন একটি প্রদর্শনীকে চোখের সামনে হতে দিলেন? যারা সরল বিশ্বাসে অনুমতি দিয়েছেন, তারা কি বুঝতে পারেননি এই প্রদর্শনীর রাজনৈতিক এবং সামাজিক বার্তা কী হতে পারে?
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে খেলা করা, শহিদদের স্মৃতিকে কলুষিত করা, রাজাকারদের বীর বানানো, এসব কোনো দিনই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না। এটি ইতিহাসের বিরুদ্ধে অপরাধ। আর এই অপরাধের দায়ে শুধু শিবির নয়, যারা এই আয়োজন সম্ভব করতে সহায়তা করেছে বা চুপ থেকেছে, তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে।
দেশ একদিকে নতুন এক রাজনৈতিক অধ্যায়ে প্রবেশ করছে, অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বারবার অতীত ফিরিয়ে আনতে চাইছে। এই দ্বন্দ্বে আমাদের পক্ষ বেছে নেওয়ার সময় এখনই। আমরা কি তাদের ভুলে যাওয়া অতীতকে ফিরিয়ে আনতে দেব, নাকি ইতিহাসের পক্ষে দাঁড়িয়ে সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ব?
ঘৃণার ইতিহাসকে গৌরব বানানোর যে অপচেষ্টা শিবির চালাচ্ছে, তা প্রতিহত করতেই হবে।
যে ক্যাম্পাস বারবার মুক্তিযুদ্ধ, গণআন্দোলন ও প্রগতিশীল চেতনার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে, সেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের মহিমান্বিত করার দুঃসাহস শিবির দেখাতে পারল কীভাবে? আর এই প্রশ্ন শুধু শিবিরের উদ্দেশে নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সমাজের বিবেকবান অংশের প্রতিও। যারা এই অপতৎপরতার আগে বা পরে প্রতিক্রিয়া জানাতে অনেকটাই নীরব থেকেছেন।
ছাত্রশিবির যে রাজাকারদের ‘শহিদ’ বা ‘নিরপরাধ’ ভিকটিম হিসেবে তুলে ধরেছে, তা নিছক প্রদর্শনী নয়। এর মাধ্যমে কেবল তারা নিজেদের মতাদর্শিক অবস্থান পরিষ্কার করেনি, বরং প্রমাণ করেছে তাদের চেতনাগত ভিত্তি আজও ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির সঙ্গেই যুক্ত।
শিবিরের এই অপচেষ্টা একদিনে গঠিত হয়নি। বহু বছর ধরেই তারা ধীরে ধীরে ইতিহাস বিকৃতির নানান ছক কষে চলেছে। কখনো ছাত্র রাজনীতির নামে সহিংসতা ছড়িয়েছে, কখনো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা কথিত ‘বিকল্প বয়ান’ তৈরি করেছে। এবার তারা আরও একধাপ এগিয়ে এসেছে। প্রশ্ন হলো, এবার কি আমরা সবাই এক ধাপ পিছিয়ে গেছি?
এখানে আরেকটি দিক গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। এই প্রদর্শনীর পেছনে কে বা কারা প্রশাসনিকভাবে অনুমতি দিয়েছেন? কীভাবে এত স্পর্শকাতর একটি বিষয় ‘কেউ না দেখে’ অথবা ‘না বুঝে’ অনুমোদন দিতে পারলেন? এটা নিছক প্রশাসনিক গাফিলতি, না কি পরিকল্পিত প্রশ্রয়? যারা এই অনুমতির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো জবাবদিহিতা নেই। অথচ এটি ছিল স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কর্মকা-, রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব প্রচারের একটি জঘন্য উদাহরণ।
অথচ পুরো ঘটনায় সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিকটি হলো, ছাত্রশিবির তাদের এই কর্মকা-কে ‘প্রতিবাদী’ বলে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে। তারা বলছে, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার’ শিকার তাদের নেতারা। অথচ বাস্তবতা হলো, যুদ্ধাপরাধ একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। এতে দলীয় রাজনীতি বা মতপার্থক্যের কোনো স্থান নেই। যে অপরাধীরা মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী কাজে যুক্ত ছিলেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ মানেই জাতির বিবেকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
ছাত্রশিবির তাদের ইতিহাসকে গৌরবময় করে তুলতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ইতিহাসের কোন অংশ তারা গৌরবের বলে মনে করে? শহিদদের রক্তে রঞ্জিত স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া? একাত্তরের খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ? নাকি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজকে জায়েজ করার অপচেষ্টা?
শিবির যখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এই প্রদশর্নী চালাল তখন প্রতিবাদে ছেঁয়ে গেছে সামাজিক মাধ্যম। তাদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার আরিফ জেবতিকের লেখা থেকে শিবির শিক্ষা নিতে পারে। আরিফ জেবতিক যা লিখেছেন তার সারমর্ম হলো, ‘গোলাম আযমকে বায়তুল মোকাররমে জুটা পেটা করা হয়। সেই ইতিহাস জাতির মনে আছে। কিন্তু জুতা পেটা খাওয়ার আগে তিনি মসজিদে নামাজ আদায় করেছিলেন কি না তা কেউ মনে রাখেনি। ইতিহাস কখনো জিজ্ঞেস করে না, নিজামীকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুতা পেটা করা হয়, তার আগে সে তো সিনেট ভবনে ঢুকে চা বিস্কুট খেল, তখন কেউ কিছু বলল না কেন? ইতিহাস চা বিস্কুট খাওয়া মনে রাখে না শুধু লিখে রাখে যে নিজামীকে জুতাপেটা করা হয়েছে।
ইতিহাস লিখে ফেলেছে, জামায়াতের চরম ও তুখোড় দিনেও তারা তাদের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের ছবি টিএসসি থেকে নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল। এখন তারা সেখানে সুখরঞ্জন বালির পোস্টার মারুক, খালেদা জিয়ার কোটেশন ঝোলাক, এই সান্ত¡নাটুকু পেতে দেন। নিজামী, গোলাম আযম এদের গায়ের জুতার বাড়ির ধুলোটাও তো কেউ না কেউ মুছে দিয়েছিল সেই সময়, কিন্তু ইতিহাস থেকে কলঙ্ক কি মুছতে পেরেছিল!’
সুতরাং শিবির যদি ভেবে থাকে এসব করে তারা ইতিহাসের কাপুরুষদের বীরপুরুষ বানাবে তা নিছকই ভুল। ইতিহাসে যা ঘৃণার অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে, তাকে সম্মানের স্থানে কখনই আনা যাবে না। জাতি আনতে দেবে না। শিবিরকে এই কথাটা মনে রাখতে হবে।
ছাত্রশিবির যতবার তাদের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের ‘বীর’ হিসেবে তুলে ধরবে, ততবারই এই সমাজে তাদের অবস্থান আরও কোণঠাসা হবে। আজকের শিক্ষার্থীরা কেবল অতীত জানে না, তারা তা বিশ্লেষণও করতে পারে। আওয়ামী লীগ বিরোধিতা এক জিনিস, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা একেবারেই অন্য। রাজনৈতিক মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের সত্য বিকৃত করার অধিকার কারো নেই।
শুধু শিবির নয়, যারা এ ধরনের কর্মকা-ে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাদের সবাইকে চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ইতিহাসের সঙ্গে প্রতারণা করলে তা ইতিহাসই মনে রাখে। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন আর কখনো এমন ঘৃণিত অপপ্রচার দেখে বেড়ে না ওঠে সেজন্য আমাদের সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার, গৌরব আর অস্তিত্বের ভিত্তি। সেই ভিত্তিকে যারা ধ্বংস করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া শুধু দায়িত্ব নয়, কর্তব্য।