ঢাকা মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

উন্নয়নের ছলনায় ডুবছে শহর

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৫, ০১:০৯ এএম

নগরায়ণের গতি যেন রথচক্রে বাঁধা এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে শহরের চেহারা- উঁচু ভবন, নতুন রাস্তা, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, আর বিশাল শপিং মল। কিন্তু এই উন্নয়নের ছলনায় ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য প্রধান শহরগুলো ক্রমেই হয়ে উঠছে পানিতে ডোবা এক দুঃস্বপ্ন। বর্ষা এলেই নগরজীবনে দেখা দেয় চরম দুর্ভোগ। জলাবদ্ধতা, যানজট, রোগব্যাধি, ও জীবনের গতি থমকে যাওয়া। ২০২৫ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে টানা কয়েকদিনের ভারি বর্ষণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন শহরে যে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে, তা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা আদৌ কতটা প্রস্তুত নগর উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়?
জলাবদ্ধতার বর্তমান চিত্র

২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণে মাত্র এক সপ্তাহেই ঢাকায় প্রায় ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ফলাফল? রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বসুন্ধরা, ধানমন্ডি, বাড্ডা, উত্তরা, পুরান ঢাকা, তলিয়ে গেছে পানির নিচে। বৃষ্টি থামার পরেও ২-৩ দিন ধরে পানি জমে থাকায় বহু অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ঢাকা শহরের মতো অবস্থা চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরেও। শহর যেন রূপ নিয়েছে এক বিশাল জলাধারে।
নগর উন্নয়নের নামে পরিকল্পনাহীনতা

বাংলাদেশে নগর উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি রাস্তাঘাট সংস্কার, নতুন প্রকল্পের ফিতা কাটা, বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ। কিন্তু উন্নয়ন মানে কি শুধুই অবকাঠামো? উন্নয়ন কি কেবল দৃশ্যমান ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধিই? প্রকৃতপক্ষে, প্রকৌশলগত পরিকল্পনা ও পরিবেশগত ভারসাম্য না থাকলে সেই উন্নয়ন নগরবাসীর জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

দেখা গেছে, নতুন রাস্তা বা মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলাকালীন পুরাতন ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়েছে, অথচ তা পুনর্নির্মাণ বা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ঢাকার ড্রেনগুলো অনেক পুরোনো, অনেক জায়গায় সম্পূর্ণ অকেজো। কোথাও কোথাও খাল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসন বা বাণিজ্যিক স্থাপনা। এগুলো নগর উন্নয়নের নামে ‘ছদ্ম উন্নয়ন’, যার মূল লক্ষ্য ব্যবসায়িক লাভ, জনস্বার্থ নয়।

প্রাকৃতিক জলাধার ও খাল বিলুপ্তি : জলাবদ্ধতার মূল কারণ

ঢাকা এক সময় ছিল খালবেষ্টিত নগরী। প্রায় ৫০টির মতো খাল ছিল, যা শহরের অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নদীতে পৌঁছে দিত। কিন্তু আজ? ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ২৬টি খাল কার্যকর রয়েছে, বাকিগুলো দখল ও দূষণের কারণে মৃতপ্রায়।

দখলদাররা খাল ও নালার জায়গায় গড়ে তুলেছে মার্কেট, বসতবাড়ি, এমনকি সরকারি স্থাপনাও। খালগুলোর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে একটু ভারি বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাটে পানি জমে যাচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।

নির্মাণ সামগ্রী ও আবর্জনায় ড্রেন বন্ধ

নগরে চলমান নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বালি, সিমেন্ট, পাথর ও ইট প্রভৃতি উপকরণ বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে গিয়ে পড়ে এবং ড্রেন বন্ধ করে দেয়। তা ছাড়া নগরবাসীর অসচেতনতা, যথেচ্ছভাবে আবর্জনা ফেলা, পলিথিনের ব্যবহার, সবই ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকেজো করে দিচ্ছে। ২০২৫ সালের বর্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বহু জায়গায় ড্রেনের পানি উল্টো রাস্তায় উঠে আসছে, যার ফলে নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।

জলাবদ্ধতার ভয়াবহ প্রভাব

১. সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ
বাসা থেকে অফিস বা স্কুল পর্যন্ত যাতায়াত কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। রিকশা, গাড়ি, এমনকি হাঁটাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় যানজট, স্কুল-কলেজে পাঠদানে ব্যাঘাত, সব মিলিয়ে শহর থমকে যায়।

২. স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি
পানি জমে থাকায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগ, জন্ডিস ইত্যাদির প্রকোপ বেড়ে যায়। ২০২৫ সালে শুধু জুলাই-আগস্ট মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী)।

৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি
দোকানপাট বন্ধ, কর্মস্থলে যাওয়া সম্ভব না হওয়া, পণ্যের পরিবহন বিলম্ব, সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিকরা চরম ক্ষতির মুখে পড়ে।

নগর পরিকল্পনার ঘাটতি ও দুর্নীতির চক্র

নগর উন্নয়নের নামে নেওয়া নানা প্রকল্পে পরিকল্পনার অভাব ও দুর্নীতির ছায়া স্পষ্ট। অনেক প্রকল্প শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না, কিংবা মানসম্মতভাবে কাজ হয় না। ড্রেন নির্মাণের কাজ নি¤œমানের, জলাশয় পূরণ করে ‘উন্নয়ন’ দেখানো হয়। দীর্ঘ মেয়াদে এসব কাজ শহরকে আরও অযোগ্য করে তোলে।

এ ছাড়াও সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা, ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, রাজউক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে পর্যাপ্ত যোগাযোগ ও তথ্য বিনিময় না থাকার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা যায় জটিলতা।

সমাধানের পথ : উন্নয়ন বনাম টেকসই পরিকল্পনা

জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে হলে একক কোনো সমাধান যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন সম্মিলিত, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা।

১. খাল উদ্ধার ও পুনঃখনন
দখলদারদের উচ্ছেদ করে সরকারি খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। সেগুলো নিয়মিত খনন ও রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে, যাতে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ বজায় থাকে।

২. পর্যাপ্ত ও কার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা
প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে ড্রেনেজ প্ল্যান সংযুক্ত থাকতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিপাতের চাপ সামলাতে সক্ষম আধুনিক ড্রেন নির্মাণ করতে হবে।

৩. সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনের প্রয়োগ
নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ড্রেনে আবর্জনা না ফেলা, খাল দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন ইত্যাদি। প্রয়োজনে জরিমানাসহ কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।

৪. সবুজায়ন ও খোলা স্থান সংরক্ষণ
খোলা জায়গা, পার্ক, বাগান ও জলাশয় নগরের ফুসফুস। এগুলো সংরক্ষণ করে জলরোধ ও জলধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।

৫. ডিজিটাল ম্যাপ ও ডেটানির্ভর পরিকল্পনা
নগরের প্রতিটি ড্রেন, খাল, রাস্তাঘাট ও জলাধারের একটি ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করে পরিকল্পনা নিতে হবে। কোথায় পানি জমে, কোন এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, এসব ডেটার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, জলাবদ্ধতা এখন আর কেবল একটি মৌসুমি দুর্ভোগ নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে নগর জীবনের এক ভয়াবহ স্থায়ী সংকট। আমরা যদি এই সমস্যার গভীরতা বুঝে এখনই টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ না করি, তবে ভবিষ্যতের শহর আরও বেশি অচল হয়ে পড়বে। উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তা যেন প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান নিশ্চিত করে হয়। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলোকে বাসযোগ্য রাখতে হলে খাল, জলাধার ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন, সরকারি সংস্থার সমন্বয়, এবং জনসচেতনতা তৈরি, এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো নগর উন্নয়নের নামে আমরা প্রতিনিয়ত যে জলাবদ্ধতার ফাঁদ তৈরি করছি, তা একদিন পুরো শহরকেই বসবাসের অনুপযোগী করে তুলবে।

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও গবেষক