ডাকসু নির্বাচন কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ছাত্র সংসদের ভোট নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতীক ও ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশক। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণআন্দোলন থেকে ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। তাই ডাকসু নির্বাচন গণতন্ত্রের মেরুদ- শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবাসিক হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের যে ঘোষণা দিয়েছে, তা ইতোমধ্যে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি করেছে। একপক্ষের দাবি এতে সহিংসতা ও দখলদারিত্ব রোধ সম্ভব হবে। অন্যপক্ষ বলছে, এর ফলে প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক রাজনীতি দুর্বল হবে, আর গোপন রাজনীতি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গোপন রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার কোনো উপায় নেই। বরং প্রকাশ্য রাজনীতি সীমিত হলে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যায়, আর স্বাধীন বা ভিন্নমতের শিক্ষার্থীরা কোণঠাসা হয়।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন শিক্ষার্থীদের আস্থা নড়বড়ে করে দিয়েছিল। অভিযোগ ছিল, ভোটে প্রশাসনের পক্ষপাত, ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্ব, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অনিয়ম হয়েছে। এবারের নির্বাচনেও যদি একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাতে কেবল শিক্ষার্থীদের হতাশাই বাড়াবে না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকেও কলঙ্কিত করবে।
এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রথমবারের মতো ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ। এই সংগঠনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা ও তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে ছাত্রদল, বামপন্থি জোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে নির্বাচন আরও বহুমাত্রিক রূপ নেবে। কিন্তু নির্বাচনের প্রকৃত প্রতিযোগিতামূলক চরিত্র নির্ভর করবে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার ওপর।
শিক্ষার্থীদের অনেকের মত, সহিংসতা, সিট দখল, জুলুম কিংবা গোপন রাজনীতি বন্ধের জন্য প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং প্রয়োজন সুষ্ঠু আবাসন নীতি, ন্যায়সঙ্গত নিয়ম প্রয়োগ ও জবাবদিহিতা। বিশ্ববিদ্যালয় যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে, তবে সহিংসতা বা দখলদারিত্ব টিকতে পারবে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র চর্চা সংকুচিত হবে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটাতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে প্রশাসন, শিক্ষক, রাজনৈতিক সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কোনো পক্ষের প্রভাব বিস্তার নয়, বরং মুক্ত অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডাকসু শুধু নেতৃত্ব তৈরির স্থান নয়; এটি শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার মহাবিদ্যালয়।
যদি এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নয়, গোটা জাতির জন্য গণতন্ত্রের এক নতুন আস্থার বার্তা হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তবে সেটি হয়ে উঠবে গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা হত্যার এক বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি জাতির বিবেক, ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক চেতনার অন্যতম উর্বর ভিত্তি। মতের পার্থক্য থাকুক, কিন্তু সেই পার্থক্য যেন গণতান্ত্রিক চর্চা ও চিন্তাশীল বিতর্কের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সহিংসতা, হুমকি-ধমকি কিংবা দলীয় নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্রসমাজের উচিত নিজেদের নেতৃত্ব নিজেরাই গড়ে তোলা। আর সেই পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনের।
আমরা আশা করব, এবারের ডাকসু নির্বাচন, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং উৎসবমুখর করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন