বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের অলিগলিতে গড়ে ওঠা মাদ্রাসাগুলো বহু শতাব্দী ধরে ইসলামি শিক্ষা ও নৈতিকতার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে বা স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ দ্বীনি শিক্ষা লাভের এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল এই প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু সম্প্রতি এই পবিত্র শিক্ষাঙ্গনগুলোর প্রাচীরের ভেতর থেকে একের পর এক ভেসে আসছে শিশু বলাৎকারের মতো পৈশাচিক নির্যাতনের খবর। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর কিছু শিক্ষক নামধারী ব্যক্তির পাশবিক অত্যাচার আমাদের সমাজের এক ভয়াবহ ক্ষতকে উন্মোচিত করেছে, যা একদিকে যেমন ইসলামি শিক্ষার ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করছে, তেমনই জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তাকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ। এই নীরব মহামারি থেকে আমাদের শিশুদের রক্ষা করতে প্রয়োজন সম্মিলিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ। মাদ্রাসায় ছেলে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, এর একটি বড় অংশই ঘটে আবাসিক কওমি মাদ্রাসাগুলোতে, যা মূলত সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে পরিচালিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতার অভাব, অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়া নির্যাতনকারীদের সাহস জোগায়। এই সামাজিক ব্যাধির পেছনের কারণগুলো বহুমাত্রিক যেমন- বাংলাদেশের আলিয়া মাদ্রাসাগুলো ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০২০’-এর আওতায় পরিচালিত হলেও হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসা এর আওতার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের পাঠ্যক্রম, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া, এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারি কোনো কার্যকর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এই নিয়ন্ত্রণহীনতাই কিছু ব্যক্তিকে বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করার সুযোগ করে দেয়।
মাদ্রাসার আবাসিক পরিবেশে শিক্ষকরা প্রায়শই ‘জ্ঞানদাতা’ এবং ‘অভিভাবক’ উভয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই অসীম ক্ষমতা এবং শিশুদের অসহায়ত্ব ও সরলতার সুযোগ নেয় কিছু বিকৃত রুচির শিক্ষক। শিশুরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় এবং শিক্ষকদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও ভয় কাজ করায়, তারা নির্যাতনের শিকার হলেও মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পায় না। ভয়, লজ্জা এবং ভবিষ্যতে কী হবে, এই আতঙ্কে তারা নীরবে অত্যাচার সহ্য করে যায়। যৌন নির্যাতনের মতো বিষয় নিয়ে সমাজে কথা বলতে সংকোচ বোধ করা এবং শিশু ও তার পরিবারকে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রবণতা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সম্মানহানির ভয়ে এবং স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীদের চাপে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। ফলে অপরাধীরা শাস্তি না পাওয়ায় অন্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়।
অনেক দরিদ্র পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের ভরণপোষণ ও শিক্ষার জন্য মাদ্রাসার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকেন। ফলে, সন্তানের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠলেও তারা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস বা সক্ষমতা রাখেন না। নির্যাতনের শিকার শিশু বা তার পরিবার অভিযোগ করার সাহস করলেও আইনি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘ। প্রভাবশালী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা এবং সাক্ষী পাওয়া প্রায়শই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, যা অন্যদের এই ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত করে। ধর্মীয় আবরণে নিজেদের সুরক্ষিত মনে করায় তারা এ ধরনের অপরাধ করতে দ্বিধা বোধ করে না। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত অসংখ্য প্রতিবেদন এই নির্মম বাস্তবতার সাক্ষী। উদাহরণস্বরূপ, অতীতে বিভিন্ন সময়ে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মাদ্রাসায় ছাত্রদের ওপর যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, যেখানে একাধিক শিক্ষককে এই ধরনের অভিযোগে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়শই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায় এবং এ সংক্রান্ত মামলা ও বিচার প্রাপ্তির হার অত্যন্ত নগণ্য। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ (এমজেএফ)-এর গবেষণাতেও উঠে এসেছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে শিশুরা, বিশেষ করে মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্ররা যৌন নিপীড়নের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সমন্বিত পদক্ষেপের রূপরেখা এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে একটি বহুমাত্রিক ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সব ধারার মাদ্রাসাকে একটি একীভূত আইন ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার অধীনে আনতে হবে। ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আইন’-এর সংশোধন করে অথবা একটি নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সব কওমি মাদ্রাসাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ সেল গঠন করতে হবে। এই সেলের দায়িত্ব হবে নিয়মিত ও আকস্মিক পরিদর্শনের মাধ্যমে মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ, শিশুদের নিরাপত্তা এবং শিক্ষকদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও চারিত্রিক সনদ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষকের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে ডেটাবেজে সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে কোনো অপরাধী এক মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্য মাদ্রাসায় চাকরি না নিতে পারে। এ ছাড়াও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি করতে হবে এবং অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
‘শিশু আইন, ২০১৩’-এর যথাযথ প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রতিটি মাদ্রাসায় স্থানীয় শিক্ষাবিদ, মসজিদের ইমাম, অভিভাবক প্রতিনিধি এবং সমাজকর্মীদের সমন্বয়ে একটি ‘শিশু সুরক্ষা কমিটি’ গঠন করতে হবে। এই কমিটি মাদ্রাসার পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করবে এবং শিশুদের যেকোনো অভিযোগ গুরুত্বসহকারে শুনে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবে। শিশুদের জন্য প্রতিটি মাদ্রাসায় একটি ‘অভিযোগ বাক্স’ স্থাপন করতে হবে, যেখানে তারা নির্ভয়ে তাদের সমস্যার কথা লিখে জানাতে পারে। শিশু যৌন নির্যাতন কী এবং কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যায়, সে বিষয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। শিশুদের বোঝাতে হবে যে, তাদের শরীরের ওপর তাদের অধিকার আছে এবং যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার তাদের রয়েছে।
এ ছাড়াও, একটি কেন্দ্রীয় টোল-ফ্রি হটলাইন নম্বর চালু করা যেতে পারে, যেখানে শিশু বা তার অভিভাবক সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবে। নির্যাতিত শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যার জন্য মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলর নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের মানসিক ট্রমা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতা এবং এর প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামা এবং ইসলামি চিন্তাবিদদের এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে হবে। মসজিদ-মাদ্রাসা এবং ইসলামি জলসায় শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান তুলে ধরে এর ইসলামি বিধান অনুযায়ী যে কঠোর শাস্তির যোগ্য, তা প্রচার করতে হবে। তাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরই পারে এই সামাজিক ব্যাধি নির্মূলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে। মনে রাখতে হবে, ইসলামে শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ‘ছেলে শিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে’। এই সত্যটি সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ভুক্তভোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
মাদ্রাসা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুষ্টিমেয় অপরাধীর কারণে এই পবিত্র শিক্ষাঙ্গনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে না। শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুস্থ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের সবার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। সরকারের কঠোর আইন প্রয়োগ, পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, সামাজিক সচেতনতা এবং ধর্মীয় নেতাদের ইতিবাচক ভূমিকার মাধ্যমেই কেবল মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতনের এই অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব। আসুন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে এবং মাদ্রাসাকে প্রকৃত অর্থেই জ্ঞান ও নৈতিকতার বাতিঘরে পরিণত করতে আজই ঐক্যবদ্ধ হই।

 
                             
                                    
-20250818220658.webp)
 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন