বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে সাপের কামড় দীর্ঘদিন ধরেই ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। ধানখেত, খামার, বাগান কিংবা বসতভিটায় কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বহু মানুষ সাপের দংশনের শিকার হচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পান না। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে গেলেও দেখা যায়, সাপের বিষ প্রতিষেধক অ্যান্টিভেনম মজুত নেই। ফলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরিবর্তে রোগীকে রেফার করা হয় জেলা বা বিভাগীয় হাসপাতালে। ততক্ষণে অমূল্য সময় নষ্ট হয়ে যায়, আর বহু রোগীর প্রাণ মাঝপথেই ঝরে পড়ে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী, সাপের কামড়ের পর প্রথম ৩০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করলে তা সবচেয়ে কার্যকর। এ সময়সীমার মধ্যে প্রতিষেধক না পেলে বিষ দ্রুত স্নায়ুতন্ত্র ও রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে পড়ে, রোগী মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। কিন্তু বাস্তবতায় গ্রামীণ সড়কের দুরবস্থা, যানবাহনের সীমাবদ্ধতা ও আর্থিক অসুবিধা সব মিলিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরা জেলা শহরে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ যেন এক নির্মম ‘বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু’, যা বর্তমান সভ্য সমাজে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রশ্ন উঠছে, যেখানে সাপের কামড়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি, সেখানে কেন উপজেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম থাকবে না? গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন, এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার জনের মৃত্যু হয়। আক্রান্তের ৯৫ শতাংশ ঘটনা ঘটে গ্রামীণ এলাকায়। অর্থাৎ ঝুঁকি যেখানে বেশি, চিকিৎসার ঘাটতিও সেখানেই প্রকট। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে সাপের উপদ্রব তুলনামূলকভাবে সীমিত, অথচ জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালেই অ্যান্টিভেনম সংরক্ষিত থাকে। এটি নিঃসন্দেহে এক অযৌক্তিক বৈষম্য।
আরও একটি বড় সমস্যা হলো- অ্যান্টিভেনমের ব্যয়বহুলতা ও প্রাপ্যতা। বর্তমানে বাজারে একটি ভায়ালের দাম প্রায় ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, তবে সরকারি ক্রয় ও চিকিৎসা সেবার খরচ বিবেচনায় প্রতিটি ইনজেকশনের ব্যয় ১০ হাজার টাকারও বেশি হতে পারে। একজন রোগীকে সেরে তুলতে একাধিক ভায়াল প্রয়োজন হয়। প্রান্তিক মানুষের পক্ষে এ ব্যয় বহন করা প্রায় অসম্ভব। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে অ্যান্টিভেনম সহজলভ্য ও সুলভ করা এখন সময়ের দাবি।
এ অবস্থায় করণীয় কী? প্রথমত, প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে সময়মতো অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে পারেন। তৃতীয়ত, উপজেলা হাসপাতালে বিশেষ সাপে কাটা চিকিৎসা কর্নার চালু করা যেতে পারে, যেখানে জরুরি সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। চতুর্থত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে কেউ আর ওঝা-বৈদ্যের কাছে না গিয়ে সরাসরি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন।
প্রতিটি প্রাণই রাষ্ট্রের জন্য অমূল্য। প্রতিবছর হাজারো মানুষ সাপের কামড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন, অথচ এ মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। শুধু সময়মতো অ্যান্টিভেনম প্রয়োগই পারে অগণিত প্রাণ বাঁচাতে। তাই এখনই সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। উপজেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম রাখতে হবে, প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসা সহজলভ্য করতে হবে এবং বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মিছিল থামাতেই হবে।
শিব্বির আহমেদ রানা, লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন