ঢাকা সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ঢামেকে ঠিকাদারির সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫, ০১:২৩ এএম

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ হাজার রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন, যাদের অধিকাংশই সমাজের নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। দেশের এই ‘শেষ আশ্রয়স্থলে’ চিকিৎসাসেবা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা রক্ষা করাও জরুরি। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভয়াবহ। গোটা হাসপাতালজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রভাবশালী ঠিকাদারি সিন্ডিকেট দখলদারি, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যত জিম্মি করে রেখেছে।

বোরবার রূপালী বাংলাদেশে ‘ছাত্রনেতাদের ছড়ি ঘোরে ঢামেকে’ শিরোনামের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বিগত সরকারের সময় ‘বঞ্চিত’ থাকার অজুহাতে ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান কিছু নেতাসহ প্রভাবশালী ডাক্তাররা এখন ঢামেকে ঠিকাদারির নতুন এক চক্র গড়ে তুলেছে। তারা হাসপাতালের পরিচালক ও উপ-পরিচালকের কাছে টেন্ডার তদবির করছে, হুমকি দিচ্ছে এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে নির্দিষ্ট কোম্পানিগুলোকে কাজ পাইয়ে দিতে চাপ প্রয়োগ করছে। এখানেই শেষ নয়, তাদের নির্দেশে রোগীদের জোরপূর্বক নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো, হাসপাতালের ভেতর সিন্ডিকেট চালিয়ে অ্যাম্বুলেন্স, মর্গ, ক্যান্টিন, ওষুধ সরবরাহসহ প্রায় প্রতিটি সেবা খাতে দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগও এসেছে।
হাসপাতাল স্পর্শকাতর স্থান, যেখানে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রতিটি সেবা, সেখানে এ ধরনের প্রভাব বিস্তার, দখলবাজি ও রাজনৈতিক তদবির কেবল নিন্দনীয়ই নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ও মানবিক অপরাধ। অধিক উদ্বেগের বিষয় হলো, সুস্পষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যা দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করছে এবং চিকিৎসাসেবাকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

ঢামেকে ঠিকাদারি সিন্ডিকেট শুধু স্বাস্থ্যসেবার মান নষ্ট করছে না, এটি পুরো স্বাস্থ্য খাতের ওপর জনগণের আস্থা ধ্বংস করছে। সরকারি ওষুধ থাকা সত্ত্বেও রোগীদের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করা, মর্গে লাশ হস্তান্তরের নামে অর্থ আদায়, দালালচক্রের আধিপত্য এবং অতিরিক্ত খাবার দাম আদায়ের মতো অভিযোগ আজ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‌্যাব-পুলিশ মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও তা চিরস্থায়ী কোনো সমাধান আনতে পারেনি। একবার ধরা পড়ার পর ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে এসব চক্র।

এমনিতেই ঢামেকের সেবা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। হাসপাতালের ভেতর ও বাইরে অ্যাম্বুলেন্স মালিক এবং সিন্ডিকেট জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। সাধারণত দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে ভাড়া যেখানে পাঁচশ থেকে আটশ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে দাবি করা হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। এ ছাড়াও এখানকার মর্গে লাশ নিয়েও রয়েছে ব্যবসার অভিযোগ। মৃতদেহ হস্তান্তরে দালালচক্র আত্মীয়দের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপর যুক্ত হয়েছে ১৫ বছর বঞ্চিত থাকার অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন সিন্ডিকেট। সরকারি ওষুধ ও খাবার সরবরাহ কার্যক্রমও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এসব সিন্ডিকেটের হাতে।

আমরা মনে করি, দেশের স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে যদি  স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিকতা না থাকে, তাহলে দেশের অসংখ্য অসহায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা সাধারণ রোগীর কথা চিন্তা না করে নিজেদেরে স্বার্থকে বড় করে দেখছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঢামেককে ঠিকাদারির সিন্ডিকেট মুক্ত করে জনস্বাস্থ্যের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। ১৫ বছর বঞ্চিত থাকা রাজনৈতিক নেতাদের দায় কি সাধারণ মানুষের? সাধারণ মানুষকে শোষণ করে সুবিধাপ্রাপ্তির অধিকার তাদের কে দিয়েছে। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কেবল একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, এটি জাতির আস্থা, দরিদ্র মানুষের শেষ ভরসা। এই ভরসাকে ধ্বংস হতে দিলে তার দায় বর্তাবে পুরো রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে ঢামেকের এই ঠিকাদারি সিন্ডিকেট ভাঙতে।