ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

হাওরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে লুটের চিহ্ন

সালমান ফরিদ, সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ১০:৫২ পিএম
  • পাউবোর তিন প্রকৌশলী ও এক ঠিকাদারের সিন্ডিকেটে হাজার কোটি টাকা নয়ছয়
  • সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর এলাকায় প্রতি বছরই নির্মাণ করতে হয় বাঁধ 
  • বড় দাগে লুটপাট হয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও স্লুইচগেট নির্মাণ, ডুবন্ত বাঁধ ও সিসিব্লক দ্বারা বাঁধ সুরক্ষা, ফ্লাড ফিউজ নির্মাণসহ বন্যা ব্যবস্থাপনা, পুনর্গঠন এবং জরুরি সহায়তা প্রকল্পে
  • ঠিকাদার স্বপন মিয়া আওয়ামী লীগের নেতা। বর্তমানে কাজ করছেন বিএনপি নেতার ছত্রছায়ায়
  • গত এক বছরে শাল্লা উপজেলার একটি প্রকল্প থেকেই ৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি
  • ৩৬ প্রকল্পে বাস্তব কাজের চেয়ে দ্বিগুণ কাজ দেখিয়ে দ্বিগুণ বিল পরিশোধ
  • তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় পাউবোর দুই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা
  • নামকাওয়াস্তে বাঁধ দেওয়া হয় ফলে পরের বছর আবার নিতে হয় প্রকল্প
  • বাঁধ নির্মাণে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি দিরাই, শাল্লা ও দোয়ারাবাজারে
  • বস্তায় বালুর বদলে মাটি ভরেই সেলাই করে নদীতে ফেলা হয় 
  • অনিয়ম ও লুটপাটর অভিযোগ নাকচ প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের

হাওর রক্ষা করবে যারা, তারাই গিলছে হাওর। নদী ভাঙনের অজুহাতে তৈরি হচ্ছে শত শত ভুয়া প্রকল্প। কোথাওবা দরকারি, কোথাওবা দরকার ছাড়া। আবার দরকারি প্রকল্প হলেও ব্যয় দেখানো হচ্ছে আজগুবি মাত্রায়। সামান্য ব্যয়ের জায়গায় খরচ দেখানো হচ্ছে তিন থেকে চারগুণ। অর্থ তোলা হচ্ছে দেদার। আর দিনশেষে ব্যয়ের নামমাত্র খাত দেখিয়ে পুরোটা আত্মসাৎ করে ভারি করা হচ্ছে পকেট। হাওর লুটপাটের এই কাজটি করতে তৈরি হয়েছে সরকারি অফিসার-ঠিকাদার সমন্বয়ে সিন্ডিকেট। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর একাধিক কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার মিলে পরিচালনা করা হয় ওই সিন্ডিকেট। তারা আবার ভাগ দেন নানা জায়গায়। বাদ যান না রাজনৈতিক দলের নেতারাও। বিভিন্নভাবে তাদের সুবিধা দিয়ে ‘মুখ বন্ধ’ রাখা হয়। এমনকি গণমাধ্যমের কিছু কর্মীকে হাত করা হয় আর্থিক সুবিধা দিয়ে। এভাবে চতুর্মুখি থাবায় লুটপাট চলছে সুনামগঞ্জের পুরো হাওর অঞ্চল। চলতি বছরের প্রথম দিকে হাওরের ফসল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন, জরুরি সহায়তা প্রকল্পে’ শুরু হলে সেখানে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের চার মাসের মধ্যে ভেঙে গেলে অনিয়মের বিষয়টি সামনে চলে আসে। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমেও লেখালেখি হয়।

সম্প্রতি সরেজমিনে হাওরে গিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। সুনামগঞ্জে হাওর গিলার এই কাজটির নেতৃত্বে আছেন মূলত চারজন। তাদের মধ্যে রয়েছেন পাউবো সুনামগঞ্জ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার এবং পাউবো সুনামগঞ্জ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইমদাদুল হক, সুনামগঞ্জ পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (দোয়ারাবাজার উপজেলার চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত) শমসের আলী এবং অপরজন হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদার স্বপন মিয়া। যিনি এলাকায় ‘স্বপন হাজী’ নামেই বেশি পরিচিত। সম্প্রতি একটি প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে নির্বাহী প্রকৌশলী ইমদাদুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। হাওরের উন্নয়ন কাজের টেন্ডার কে পাবেন, কত টাকার টেন্ডার হবেÑ তার সবই নির্ধারিত হয় তাদের ঈশারায়। হাওর গিলে খেতে স্থানীয় পাউবো বেছে নিয়েছে ঠিকাদার স্বপন মিয়া ওরফে স্বপন হাজিকে। তিনি সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ নেতা স্বপন মিয়াকে রাজনৈতিক সেল্টার দিতে তার ‘রাজনৈতিক সাইড’ দেখভাল করছেন ছাতক উপজেলা বিএনপি নেতা আব্দুর রহমান। 

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার শনির হাওরে ফনিউড়া, ফুটিচোরা বাঁধ, আম্মকখালীর ভাঙায় নির্মাণকাজ এখন চলমান। গত বছরও ঠিক একই সময়ে সেখানে উন্নয়ন কাজ করা হয়। এবারও কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া শনির হাওরের বেইলী বাজারেও বাঁধ, লালুরখলা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চলমান। এখানে প্রতি বছরই ভাঙন হয়। প্রতি বছরই বাঁধ নির্মাণ করতে হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, হাওরে বড় দাগে লুটপাট হয় মূলত; বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, রেগুলেটর বা স্লুইসগেট নির্মাণ, ডুবন্ত বাঁধ ও সিসিব্লক দ্বারা বাঁধ সুরক্ষিত করা, ফ্লাড ফিউজ নির্মাণসহ বন্যা ব্যবস্থাপনা, পুনর্গঠন এবং জরুরি সহায়তা প্রকল্পে। এগুলোতেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। প্রতি বছরই পানির নিচে, নদীর বুকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নিমাণের নামে বালুভর্তি বস্তা ফেলা হয়, কিন্তু কাক্সিক্ষত উপকার মেলে না। নামকাওয়াস্তে কাজ করা হয় বলে যে জায়গায় বাঁধ দেওয়া হয় সেখানে পরের বছর আবার প্রকল্প নিতে হয়। এভাবে প্রকল্প দেখিয়ে সুনামগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে সরকারি টাকা হরিলুট চলছে। এখানকার প্রায় উপজেলাই হাওর বেষ্টিত। তবে সবচেয়ে বেশি বাঁধ রয়েছে দিরাই, শাল্লা, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর এবং জামালগঞ্জ উপজেলায়। এর মধ্যে বাঁধ নির্মাণে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে দিরাই, শাল্লা ও দোয়ারাবাজারে।

সূত্র জানায়, দিরাই, শাল্লা ও দোয়ারাবাজার উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন প্রকল্পে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে, প্রাক্কলিত ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে এবং একই কাজ বিভিন্ন ঠিকাদারের নামে বারবার দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। গত এক বছরে শাল্লা উপজেলার একটি প্রকল্প থেকেই ৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। হাওর রক্ষায় বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা প্রকল্প-এফআরইএপি’র আওতায় ওই প্রকল্পে কাজের গুণগত মান শতভাগ নিশ্চিত করা হয়নি বলে প্রমাণও পায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। এতে যাদের দায়ি করা হয় তাদের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলী-২ ইমদাদুল হক, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শমসের আলীও রয়েছেন। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পরপরই শফিকুল ইসলামসহ পাউবোর দুই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত পিডি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাইছার আলমও এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, তাকে প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

পাউবো জানায়, সুনামগঞ্জ জেলার হাওরের ফসল রক্ষায় সরকার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এডিবির যৌথ অর্থায়নে পাঁচশ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প নেয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। যা বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবো। ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন, জরুরি সহায়তা প্রকল্প’ নামের এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, রেগুলেটর বা স্লুইসগেট নির্মাণ, ডুবন্ত বাঁধ সিসিব্লক দ্বারা সুরক্ষিত করা এবং ফ্লাড ফিউজ নির্মাণ। এডিবির বরাদ্দ থেকে পাঁচশ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে হাওরের ১৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে ব্যয় হবে প্রায় ২৫৬ কোটি টাকা। গেল শুকনো মৌসুমে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হলে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু হয়। 

জানা গেছে, মেগা প্রকল্পে চলমান অবস্থায় গেল শুকনো মৌসুমে ৩৬ প্রকল্পে বাস্তব কাজের চেয়ে দ্বিগুণ কাজ দেখিয়ে দ্বিগুণ  বিল পরিশোধ করা হয়। আর পিডিসহ কর্মকর্তারা এভাবেই ঠিকাদারদের নিয়ে সরকারের বিপুল পরিমাণের অর্থ লুটপাট করেন। এখানেও প্রকৌশলী-ঠিকাদার মিলে দুর্নীতি করা হয়েছে। পাউবো কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ নেতা ও তাহিরপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আজাদ হোসেনকে দিরাই ও শাল্লার কাজ দিতে দরপত্র প্রতিযোগিতায় গোপন সমঝোতা করেন। এই প্রকল্পের আওতায় দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় ৪টি প্রকল্পে প্রায় ৮০ কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন করছেন আজাদ হোসেন। দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনকারী আজাদ চেয়ারম্যান বাংলাদেশ স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক।

ডিএমপির ডিবির হাতে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার হয়ে আজাদ এখন শ্রীঘরে। পরিচয় গোপন রেখে মোটা অঙ্কের কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেওয়া আজাদকে পুরোদস্তর সহযোগিতা করেন পাউবোর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমদাদুল হক। এ কাজের দরপত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নোনা ট্রেডার্স এককভাবে দুটিতে এবং নোনা ও আহাদ যৌথভাবে দুটি কাজে অংশ নেয়। এই চারটি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭৬ কোটি টাকা। এসব কাজে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র অংশগ্রহণ হয়নি। 

এদিকে প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পরে অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ড. আ.ন.ম বজলুর রশীদকে প্রধান করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘হাওর রক্ষায় বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় চলমান কাজের গুণগত মান শতভাগ নিশ্চিত করা হয়নি। ব্লক ঢালাইয়ের জন্য প্ল্যাটফর্ম যথাযথভাবে প্রস্তুত করা হয়নি। প্রকল্পের সাইটে রক্ষিত পাথর দেখে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ধারণা করেন সেগুলো নি¤œমানের। বাঁধের পাশের গর্তগুলো ভরাট করা হয়নি। সাইট তদারকিতে কার্য সহকারী, উপসহকারী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালকের যথেষ্ট গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ঠিকাদারকে বিল দেওয়ার ক্ষেত্রেও উপসহকারী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী এবং প্রকল্প পরিচালক যথাযথভাবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করেননি।’ 

এ ছাড়াও অনুসন্ধানকালে পাউবোর একটি সূত্র জানিয়েছে, দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা নদীর তীরবর্তী এলাকার কয়েকটি প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা প্রকৃত কাজের তুলনায় অনেক বেশি। এসব প্রকল্পের মধ্যে সদর ইউনিয়নের পূর্ব মাহিপুর গ্রামের নদী ভাঙন রোধে জরুরি প্রতিরক্ষা কাজের খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ২৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। যেখানে জিওব্যাগের পরিমাণ দেখানো হয়েছে চার হাজার ৮১৮ পিস। এ প্রকল্প স্থানের দৈর্ঘ্য ৯০ মিটার। কবকরাজ গ্রামের ৯০ মিটার নদী ভাঙন প্রতিরোধে আরেক প্রকল্পে কাজ দেখিয়ে ব্যয় দাবি করা হয়েছে ২৯ লাখ নিরানব্বই হাজার টাকা। সমরিয়া সংলগ্ন এলাকায় ৭০ মিটার নদী ভাঙন রোধে কাজের জন্য ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৯ লাখ নিরানব্বই হাজার টাকা, যেখানে এই ব্যয়ে চার হাজার ৮৭০ জিওব্যাগ বালু নদীতে ফেলার কথা। পশ্চিম মাহিপুর গ্রামের একই দূরত্বের আরও একটি প্রকল্পে খরচ দেখানো হয়েছে ২৯ লাখ নিরানব্বই হাজার টাকা।

সেখানে চার হাজার ৯৫৪ জিওব্যাগ ধরা হয়েছে। শাহীনপুর বাজার সংলগ্ন এলাকায় ১২০ মিটারের নদী ভাঙন রোধ প্রকল্পে কাজের খরচ ধরা হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রকল্পে একই ঠিকাদারের নামে একাধিক কাজ দেখানো হয়েছে এবং একই কাজ ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্পের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করেই পুরো বিল উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এই কাজটির বেশিরভাগই করছে সুনামগঞ্জ পাউবোর প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার স্বপন মিয়া ওরফে স্বপন হাজি সিন্ডিকেট। 

সংশ্লিষ্ট একটি ঠিকাদারি সূত্র জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের আশীর্বাদে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সুনামগঞ্জ জেলার বেশির ভাগ কাজই পেতেন স্বপন মিয়া। বর্তমানে দোয়ারাবাজার উপজেলা সদর ইউনিয়নের মাছিমপুর নদী ভাঙন এলাকায় দেড় কোটি টাকার কাজ করছেন তিনি। সেখানে সরেজমিনে গেলে দেখা যায় নানা অসঙ্গতি। বস্তায় নির্দিষ্ট পরিমাণে বালু না ভরেই তা সেলাই করে নদীতে ফেলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বস্তায় বালুর পরিবর্তে নদীর পাশের জমি থেকে মাটি ভরতে দেখা গেছে শ্রমিকদের। এভাবে বালুর পরিবর্তে মাটি দিয়ে ভরা বস্তা নদীতে ফেলে ভাঙনরোধের চেষ্টা চালানোয় প্রতি বছরই একই জায়গায় ফের ভাঙন দেখা দেয়। ফলে আবারও সেই একই জায়গায় বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে। আওয়ামী আমল দূর হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তাদের বিশ্বস্ত ও দুর্নীতির সহযোগী হওয়ায় টেন্ডার প্রদানে আওয়ামী লীগ নেতা স্বপন মিয়াকেই তারা বেছে নেন। নানা কৌশলে তাকে পাইয়ে দেন সেগুলো। এরপর তারা ভাগবাটোয়ারা করে নেন বরাদ্দের অর্থ।

পাউবোর কর্তাদের নিয়ে স্বপন মিয়া হাওর গিলেই ক্ষান্ত নন। ছাতক শহরের একাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্যবসার কথা বলে, বালুপাথর, ভাঙারি মালামাল, টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে স্বপন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, সরল বিশ্বাসে তারা টাকা দিলেও পরে টাকা ফেরত চাইতে গেলে হামলা মামলার ভয় দেখান তিনি। আওয়ামী আমলে তার প্রভাব ছিল একচেটিয়া। ভয়ে কেউ কোনো কথা বলতেন না। ছাতক বাজারের ব্যবসায়ী আবু হুরায়রা সুরত, আশরাফুল আলম, সালেক কমিশনার, হিজবুলবারি শিমুল, সুমেন আহমেদ, কয়েছ আহমদসহ অনেকের সঙ্গে আলাপকালে তারা স্বপন হাজী বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেন।

স্বপন মিয়া অবশ্য একা একা হাওর গিলছেন না। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও অনেকে। তাদের দিয়ে তিনি আরেকটি টিকাদারি সিন্ডিকেট বানিয়েছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন কাজ আনিয়ে দেন। সম্প্রতি দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়নের সুরমা নদীর জানজাটি এলাকার নদীভাঙন প্রতিরোধমূলক ৫টি প্রকল্প একই ব্যক্তি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই প্রতিষ্ঠান তার সিন্ডিকেটেরই সদস্য। এই প্রকল্পগুলো এসেছে মেসার্স সোহাগ এন্টারপ্রাইজ নামক একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নামে। এটি স্বপনের এক ব্যাবসায়িক পার্টনারের প্রতিষ্ঠান। সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে ছাতক পৌর শহরের ম-লীভোগে স্বপনের বাসভবনে নিয়মিত বসছে নতুন সিন্ডিকেটের বৈঠক। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও নানা কর্মকা-ের পরিকল্পনা। স্থানীয়রা বলছেন, সরকারবিরোধী কর্মকা-ও পরিচালিত হচ্ছে এখান থেকে। 

দিরাই উপজেলার হাওর পাড়ের বাসিন্দারা জানান, এখানকার চাপতির হাওরের বৈশাখী বাঁধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধের উপরিভাগসহ দুপ্রান্তে মাটির উপর কার্পেট বিছানোর পরে এতে ব্লক দেওয়ার কথা থাকলেও কেবল কালনী নদীর তীর অংশে বসানো হয়েছে মানহীন কার্পেট ও ব্লক। উপরিভাগ এবং চাপতির হাওর অংশে কোনো ব্লকের কাজই করা হয়নি। এবার পুরোদমে বর্ষা কিংবা হাওরে প্রবল ঢেউ না থাকলেও সড়ক থেকে ব্লকগুলো নদী আর হাওরে চলে যাচ্ছে। চাতল স্লুইসগেটের পাশের সড়ক এবার ভেঙে গেছে। তৈরি হয়েছে বিশাল খাল। 

স্থানীয় কৃষক রুবেল আহমদ জানান, প্রায় প্রতি বছর এই বাঁধ ভেঙে বৃহৎ চাপতির হাওরের ইরি বোরো ফসল তলিয়ে যায়। সেই বৈশাখীতে স্থায়ী বাঁধ দিয়ে আমাদের ফসল রক্ষার জন্যে সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও শুধু পাউবোর দুর্নীতির কারণে স্থায়ী বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করলেও পাউবো কিংবা ঠিকাদার কেউ কথা শোনেননি। 

জামালগঞ্জ উপজেলার শনির হাওর এলাকার বেহেলী ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা আমাদের হাওরে শুধু উন্নয়ন চেয়ে দেখি। চোখের দেখায় আমাদের তুষ্ট থাকতে হয়। এটিই যেন আমাদের নিয়তি। হাওরে একদিকে জানুয়ারিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়, ঠিক এক বছরের মাথায় ডিসেম্বরে এসে সেই বাঁধের আর অস্তিত্বই থাকে না। এর মূল কারণ অনিয়ম-দুর্নীতি। 

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক কাউসার চৌধুরী বলেন, আমার বাড়ি দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের তীরে। এখানকার সন্তান হিসেবে সবসময়ই হাওর নিয়ে বাণিজ্য দেখে আসছি। এবার পাঁচশ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাট চালানো হলো যা সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বদলি করেই কাজ শেষ। অথচ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনেও মামলা করার বিধান রয়েছে। এবার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-ঠিকাদারদের দুর্নীতি রুখে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।

এদিকে ঠিকাদার স্বপন মিয়ার সঙ্গে সখ্যের বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এবং ছাতক উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির প্রথম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, যারা এটি ছড়াচ্ছে তারা মিথ্যাচার করছে। তিনি আমার এলাকার মানুষ। কিন্তু তাকে প্রশ্রয় দিই না। তবে তিনি আমাকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়ন কাজে জড়িত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমি সম্মত হইনি। অনেকে বলছেন, আমাকে নাকি পাউবো ঠিকাদারির জন্য কাজ নিতে বলছে, যা ঢাহা মিথ্যা।

অনিয়ম ও লুটপাটর বিষয়ে উপ-প্রকৌশলী শমসের আলী বলেন, আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করি। স্থানীয়দের পাশাপাশি বাইরের ঠিকাদাররাও কাজ পেয়ে থাকেন। কারো বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই। অনিয়মে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

স্বপন মিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, স্বপন হাজীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পেয়েছি। অনিয়মেরও কথা উঠেছে। পাউবোর সিদ্ধান্ত তাকে আর কোনো কাজ দেওয়া হবে না। এমনকি তিনি যাদের লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ করেন, তাদের বলা হয়েছে, অবশিষ্ট কাজ যেন তারা নিজেরা সতর্কতার সাথে করেন।

পাউবো সুনামগঞ্জ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন লাইন কেটে দেন। এরপর তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।

পাউবো সুনামগঞ্জ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইমদাদুল হক বলেন, যেসব অভিযোগ উঠেছে, অনেক ব্যাপার এর সঙ্গে জড়িত। এগুলো অনেক জটিল বিষয়। আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসে তা বিভিন্ন কারণে আসে। আমরা জড়িত না থাকলেও আসে। এখানেও তাই হয়েছে। এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।