রবিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২৫, ০১:২৮ এএম

রোহিঙ্গা সংকট: মিয়ানমারের নীরবতা, বিশ্বের উদাসীনতা

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২৫, ০১:২৮ এএম

রোহিঙ্গা সংকট: মিয়ানমারের নীরবতা, বিশ্বের উদাসীনতা

রোহিঙ্গা সংকট কেবল এক দশকের পুরোনো মানবিক বিপর্যয় নয়, এটি আধুনিক বিশ্বে মানবিক মূল্যবোধ, আন্তর্জাতিক আইন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য এক গভীর পরীক্ষা। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর চালানো ভয়াবহ, বর্বরোচিত সহিংসতা ও জাতিগত নির্মূল অভিযানের শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান প্রাণের ভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও, বাংলাদেশ মানবিকতার মহান ব্রত নিয়ে পৃথিবীর এই বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরটিকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু আট বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্য কমে আসছে, এবং সংকটের পুরো ভার এককভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চেপে বসছে। এ পরিস্থিতি শুধু মানবিক দিক থেকে করুণ নয়, বরং নিরাপত্তা, পরিবেশগত এবং সামাজিক দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য তা এক মারাত্মক ও বহুমুখী জটিলতা সৃষ্টি করেছে।

এ দীর্ঘস্থায়ী সংকট নিরসনের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে বারবার আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। সম্প্রতি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের অন্য সংখ্যালঘুদের নিয়ে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, তা এ সমস্যার টেকসই সমাধানে এক স্পষ্ট রোডম্যাপ প্রদান করে। এ প্রস্তাবনার মূল বিষয়বস্তু হলো নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি, রাখাইনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি, রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা, দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত প্রদান, গণহত্যার জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা এবং মাদক ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন। তার মতে, মিয়ানমারের বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কারের দোহাই দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে জিম্মি করে রাখা চলবে না।

অন্যদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তার বক্তব্যে তিনটি মৌলিক বিষয়কে অগ্রাধিকারে রেখেছেন। বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা, মিয়ানমারের ভেতরে বাধাহীন মানবিক সহায়তা প্রবাহ এবং শরণার্থীদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে জোরালো উন্নয়ন বিনিয়োগ। এসব আন্তর্জাতিক আহ্বান সত্ত্বেও, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর কেন কার্যকর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে না, এটাই আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এ ব্যর্থতার মূলে রয়েছে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর কৌশলগত স্বার্থের জটিল সমীকরণ।

প্রত্যাবাসন ব্যর্থতার মূলে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত:

রোহিঙ্গা সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। তবে, এর সমাধানে আন্তর্জাতিক ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত এবং ঐক্যের অভাব। চীন এবং ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মিয়ানমারে বিশাল কৌশলগত ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ রয়েছে। চীন মিয়ানমারকে তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর হিসেবে দেখে, অন্যদিকে ভারত তার ‘অ্যাক্ট অব ইস্ট পলিসি’-এর অংশ হিসেবে মিয়ানমারকে ব্যবহার করতে আগ্রহী। এ কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার্থে, এ দেশগুলো মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, যা তাদের কার্যত একধরনের কূটনৈতিক ঢাল সরবরাহ করে। এই অনৈক্য আন্তর্জাতিক চাপকে দুর্বল করে দেয় এবং সামরিক জান্তাকে দায়মুক্তির সুযোগ করে দেয়।

এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সংকট আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুত অর্থ সময়মতো আসছে না, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ তহবিলে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই অর্থায়ন কমে যাওয়া মানবিক পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে এবং বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই শৈথিল্য ও বিলম্বের ফলে শরণার্থী শিবিরগুলোয় হতাশা বাড়ছে, যা মাদক চোরাচালান, মানব পাচার এবং অভ্যন্তরীণ অপরাধমূলক কর্মকা- বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে।

টেকসই সমাধান ও সম্মিলিত পদক্ষেপের রূপরেখা:

বাংলাদেশ শুরু থেকেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে আসছে, রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র টেকসই সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাঠানো। কিন্তু এ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হলে কেবল বাগাড়ম্বর নয়, বরং একটি সুচিন্তিত, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ কৌশল বাস্তবায়নে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জোর দিতে হবে:

১. মিয়ানমারের ওপর সর্বাত্মক ও ঐক্যবদ্ধ চাপ প্রয়োগ:

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে। সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সুনির্দিষ্ট এবং কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। বিশ্বজুড়ে মিয়ানমারে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে তার ভেটো-ক্ষমতা অতিক্রম করে অথবা এর মাধ্যমে সর্বসম্মতভাবে এমন একটি প্রস্তাব পাস করতে হবে, যা মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ গ্রহণ করতে বাধ্য করবে।

২. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা:

২০১৭ সালের গণহত্যার জন্য দায়ী সামরিক কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিকভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (ওঈঈ) বা বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করার চাপ বজায় রাখা প্রত্যাবাসনের জন্য আস্থা তৈরির মূল চাবিকাঠি। যতক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা বিচার না পাবে এবং রাখাইনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। একই সঙ্গে, রাখাইনে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য নাগরিকত্ব স্বীকৃতি এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশন মোতায়েন করতে হবে।

৩. মানবিক ও উন্নয়নের ভারসাম্যপূর্ণ সহযোগিতা:

শরণার্থী শিবিরে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা জরুরি। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীকে অবশ্যই যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা (ঔড়রহঃ জবংঢ়ড়হংব চষধহ)-এর জন্য প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গভাবে দিতে হবে। পাশাপাশি, এ সংকট যেন বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়, সে জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চাপ কমাতে বৃহত আকারের অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। রোহিঙ্গাদের সীমিত আকারে শিক্ষা ও কাজের সুযোগ দিয়ে তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত করা এবং আত্মনির্ভরশীল করে তোলাও এই কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

রোহিঙ্গা সংকট আজ মানবিকতা ও বাস্তবতার এক কঠিন দোলাচলে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের একার পক্ষে এ বিশাল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বহন করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এখনো তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়, তবে এ মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে এবং তা সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। এখন প্রয়োজন কেবল কথায় নয়, বরং দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে বাধ্য করা, যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদে, সসম্মানে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারে এবং ইতিহাসের এ দীর্ঘ ববং করুণ অধ্যায়ের স্থায়ী সমাপ্তি ঘটে। এ সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক ঐক্যই হতে পারে মানবিকতার চূড়ান্ত বিজয়।

ফাহিম হাসনাত
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!