বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও এক অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, এর প্রভাব পড়েছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর। নির্বাচন নিয়ে দেখা দিয়েছে গভীর এক অনিশ্চয়তা। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি হবে না, হলে কবে হবে, কোন কাঠামোয় হবে, এসব প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের গ-ি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ পর্যন্ত। জনগণের মনে এই মুহূর্তে একটাই আকাক্সক্ষা তা হলো নির্বাচন হোক, সময়মতো হোক, এবং তা যেন হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার বারবার আশ্বস্ত করছে যে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা, সনদ বাস্তবায়ন, গণভোটের সময়সূচি ও সাংবিধানিক আদেশ জারি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দিন দিন বেড়েই চলছে। বিএনপি চায় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হোক, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চাইছে নভেম্বরেই গণভোট হোক। আর সরকারের অবস্থান অনেকটাই নির্বাচনের দিনেই গণভোটের পক্ষে। এ অবস্থায় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক সমঝোতার প্রক্রিয়া এক জটিল অচলাবস্থায় পড়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই অচলাবস্থা যত দীর্ঘ হবে, নির্বাচনের অনিশ্চয়তাও তত বাড়বে। নির্বাচন পেছালে বা স্থগিত হলে এর প্রভাব শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, দেশের অর্থনীতি, প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পড়বে। একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে বিনিয়োগ ও বাজার আস্থা নষ্ট হবে, প্রশাসন বিভক্ত হবে, আর জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হবে হতাশা ও অনিশ্চয়তা।
আমরা মনে করি, এই সংকটের মূল কারণ হলো পারস্পরিক অবিশ্বাস। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে প্রতিপক্ষ নয়, শত্রু মনে করছে। গণতান্ত্রিক ঐক্য বা সমঝোতার বদলে সবাই ব্যস্ত নিজেদের অবস্থানকে ‘জয়ী’ প্রমাণ করতে। অথচ রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া কোনো টেকসই নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন কেবল ভোটের আয়োজন নয় এটি একটি বিশ্বাসের প্রক্রিয়া, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা নিশ্চিত থাকে, ফলাফল জনগণের রায়েই নির্ধারিত হবে।
জুলাই জাতীয় সনদকে সেই বিশ্বাসের পুনর্গঠনের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই সনদকে ঘিরেই নতুন গণতান্ত্রিক রূপরেখা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। ক্ষমতার ভারসাম্য, উচ্চকক্ষের প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ছিল এর মধ্যে। কিন্তু সনদটি বাস্তবায়নের আগেই তা নিয়ে বিভাজন তৈরি হয়েছে। কোনো দল বলছে এটি রাজনৈতিক চক্রান্ত, কেউ বলছে এটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রথম ধাপ।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা যে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক, কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব সবই এক ধরনের প্রয়াসের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সফল হবে কেবল তখনই, যখন সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ একসঙ্গে কাজ করবে।
নির্বাচন নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা বা দ্বিধা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অতীতে এমন অনিশ্চয়তাই দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রশাসনিক ভাঙন ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার জন্ম দিয়েছে। তাই এখন প্রয়োজন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত, দৃঢ় নেতৃত্ব এবং সর্বোপরি, পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি।
জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে দলগুলোর মতবিরোধ গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ হলেও, তা যেন জাতীয় স্বার্থের প্রতিবন্ধক না হয়। সেদিকে সরকারকে অবশ্যই দৃষ্টিপাত করতে হবে। গণভোট ও নির্বাচন একই দিনে হোক বা আলাদাভাবে, সিদ্ধান্ত যেটাই হোক না কেন, তা হতে হবে সর্বজনগ্রহণযোগ্য ও আইনি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। অন্যথায়, নির্বাচনের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে, যা গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
মোটাদাগে বলতে গেলে, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও সময়মতো সিদ্ধান্ত। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতীক হয়, তবে তা বিলম্বিত করার কোনো যুক্তি নেই। বিলম্ব মানেই নতুন বিভাজন, নতুন সন্দেহ, নতুন অচলাবস্থা।
বাংলাদেশের মানুষ আর কোনো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখতে চায় না। তারা চায় শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
আমরা আশা করব, আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তা দূর করতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আসন্ন নির্বাচন হোক শান্তিপূর্ণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য। রাজনৈতিক নেতারা হোক সহনশীল, প্রশাসন হোক নিরপেক্ষ, আর জনগণ হোক আত্মবিশ্বাসী। নির্বাচন নিয়ে সব শঙ্কা দূর হোক, গণতন্ত্রের মূলধারায় ফিরে আসুক আস্থা, অংশগ্রহণ ও বিশ্বাসের আলোকচ্ছটা।
        
                            
                                    
                                                                
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
                                    
                                    
                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                            
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন