ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সংকট ও মুক্তির পথ

প্রান্ত চ্যাটার্জী, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অফ নেপলস, ইতালি
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৫, ০১:১৪ এএম

বাংলাদেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুপুরবেলার চেহারাটা প্রায় একই রকম। অগণিত শিক্ষার্থী এক ভবন থেকে আরেক ভবনে ছুটছে, শ্রেণিকক্ষ উপচে পড়ছে, শিক্ষকরা ক্লাসের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন, আর প্রশাসনিক দপ্তরগুলো কাগজপত্রের সাগরে ডুবে আছে। চারপাশে এত শব্দ, এত ব্যস্ততা, তবুও এক জায়গা নিঃশব্দ। সেটা হলো গবেষণাগার।

এই নিঃশব্দতা শুধু হতাশার নয়, বরং তা এক গভীর সংকেত। যে দেশ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক, উন্নত রাষ্ট্রে রূপ নিতে চায়, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলোতে এই নীরবতা আমাদের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হওয়া উচিত। উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের স্বপ্ন দেখার অর্থ কেবল অবকাঠামো গড়া নয়, বরং চিন্তার চর্চা, প্রশ্ন তোলা এবং নতুন সমাধান খোঁজার সাহসকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে পরিণত করা।

বাংলাদেশ গত দুই দশকে উচ্চশিক্ষায় বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৭০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০-এর বেশি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষার্থী ভর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বেড়েছে, হাজার হাজার পরিবারে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক তৈরি হয়েছে।

কিন্তু এ সংখ্যাগত অগ্রগতি গবেষণায় প্রতিফলিত হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরে গবেষণা ও উন্নয়নে বাংলাদেশের মোট ব্যয়ের পরিমাণ জিডিপির মাত্র ০.৩০ শতাংশ। জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের একটি প্রতিবেদনে এ হার আরও কম, মাত্র ০.০৩ শতাংশ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তুলনায়, ভারতের হার প্রায় ০.৭ শতাংশ, ভিয়েতনামের ০.৫ শতাংশের বেশি, আর চীনে তা ২.৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

এই বৈষম্য কেবল পরিসংখ্যানগত নয়, বরং একটি রাষ্ট্র কীভাবে তার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন। আমাদের দেশের বাজেটে যখন অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পরিবহন, সবকিছুতেই ব্যাপক ব্যয় হয়, তখন গবেষণা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঘুরে তাকালেই বোঝা যায় বাস্তব চিত্র কতটা উদ্বেগজনক। এক অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১৫০ কোটি টাকা সরাসরি গবেষণায় খরচ হয়েছে। এটি মোট বাজেটের মাত্র দেড় শতাংশ।

অন্যদিকে, ১০০টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টিতে গবেষণার জন্য কোনো বাজেটই নেই। তারা মূলত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে ডিগ্রি বিতরণ করে চলেছে, কিন্তু জ্ঞান সৃষ্টিতে তাদের অবদান প্রায় শূন্য। এভাবে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু পাঠদান কেন্দ্র হিসেবে থেকে যায়, তবে দেশের ভবিষ্যৎ কেবল কাগুজে ডিগ্রিধারীদের হাতে বন্দি হয়ে থাকবে।

তবুও হতাশার ভেতর কিছু আশাবাদের রেখা আছে। ২০১৯ সালে যেখানে বাংলাদেশের গবেষকরা স্কোপাসের মতো আন্তর্জাতিক ডেটাবেজে ৮ হাজারের মতো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এত স্বল্প বাজেটে এত গবেষণা সম্ভব হয়েছে শুধু অধ্যবসায়, মেধা ও আত্মনিবেদনের মাধ্যমে।

এ সাফল্য দেখায় যে বাংলাদেশে মেধার কোনো ঘাটতি নেই। ঘাটতি রয়েছে কাঠামোগত সহায়তা, স্থিতিশীল তহবিল এবং গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে নীতিনির্ধারণের রাজনৈতিক সদিচ্ছার।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বড় সমস্যা এক একটি গবেষণা সমস্যা। কৃষি খাত এখন জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা, জলাভাবে আক্রান্ত। উপযোগী ধান বা ফসলের জাত তৈরি, স্থানীয় বাস্তবতায় উপযোগী সেচ প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সবই গবেষণাভিত্তিক কাজ। বিদেশি প্রযুক্তি বা তত্ত্বের কেবল অনুকরণ করে টিকে থাকা যাবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে মাঠপর্যায়ে বাস্তব সমাধান দিতে পারে।

তেমনই গার্মেন্টস খাত, দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত। বিশ্ববাজার এখন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। শুধু সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকা সম্ভব নয়। স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, মান নিয়ন্ত্রণ, ডিজাইন, সবকিছুতেই গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণা ছাড়া বাংলাদেশের পোশাক খাত ভবিষ্যতে মূল্য সংযোজনহীন পণ্যের দাসত্বে আটকে যাবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন দ্বৈত রোগের চাপে, একদিকে ডেঙ্গু, যক্ষ্মা, জলাতঙ্কের মতো সংক্রামক রোগ, অন্যদিকে ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো অসংক্রামক রোগ। কোভিড মহামারির অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, বিদেশি গবেষণার উপর নির্ভরশীলতা বিপজ্জনক। আমাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী হতে হবে যাতে তারা স্থানীয় বাস্তবতা নিয়ে গবেষণা করতে পারে, তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং নীতিনির্ধারকদের উপযুক্ত পরামর্শ দিতে পারে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং উদ্ভাবনভিত্তিক অর্থনীতির কথা বলছি। এসব কেবল স্লোগান হয়ে থাকবে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে নতুন চিন্তা, প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা এবং সামাজিক উদ্ভাবন না আসে।

বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আজও কেবল পাঠদানের প্রতিষ্ঠানে সীমিত। অধ্যাপকদের পদোন্নতি হয় কর্মজীবনের মেয়াদ দেখে, গবেষণার মান দেখে নয়। অধিকাংশ শিক্ষক ক্লাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, গবেষণার সময় পান না। গবেষণাগারগুলোর আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, লাইব্রেরিতে আন্তর্জাতিক জার্নালের সাবস্ক্রিপশন সীমিত। নতুন শিক্ষকরা ছোট খাটো গবেষণা অনুদান পেতে হিমশিম খান, আর কেউ কেউ বিদেশে গবেষণার সুযোগ পেয়ে আর ফিরে আসেন না। এতে মেধার রক্তক্ষরণ দিন দিন বাড়ছে।

গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন, কিন্তু এর অর্থ কেবল বাজেটে একটি নতুন লাইন যোগ করা নয়। দরকার একটি গবেষণা-উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা। প্রয়োজন উন্নত ল্যাব, ক্রসডিসিপ্লিনারি প্রজেক্টের জন্য প্রতিযোগিতামূলক অনুদান, মাস্টার্স ও পিএইচডি গবেষণার জন্য বৃত্তি এবং শিক্ষক বিনিময় প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিদেশ থেকে জ্ঞান আহরণের সুযোগ।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সম্প্রতি গবেষণা তহবিল ব্যবস্থাপনায় কিছু নির্দেশিকা তৈরি করেছে, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। এ উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও শক্তিশালী করা দরকার।

শুধু রাষ্ট্র নয়, বেসরকারি খাতকেও গবেষণায় যুক্ত করা দরকার। বিশ্বের অনেক সফল উদ্ভাবন এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রয়াসে। বাংলাদেশে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল প্রায়ই চ্যারিটিতে ব্যয় হয়, গবেষণায় নয়। রাষ্ট্র চাইলে কর ছাড় বা অন্যান্য প্রণোদনার মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পারে।

আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যৌথ ডিগ্রি, সম্মিলিত পিএইচডি প্রোগ্রাম, এবং গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও শক্তিশালী হতে পারে। তবে বিদেশি অংশীদার তখনই আসবে, যখন দেখবে দেশ নিজেই গবেষণায় বিনিয়োগ করছে।

অনেকেই বলবেন, বাংলাদেশ এখনো অনেক মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যস্ত। রাস্তা, হাসপাতাল, খাদ্য নিরাপত্তা, এসবই প্রাথমিক চাহিদা। কিন্তু গবেষণা এসব চাহিদা পূরণকে আরও কার্যকর ও টেকসই করে। একটি ভালো গবেষণাই পরিকল্পনায় বিপ্লব ঘটাতে পারে। উন্নয়ন মানেই শুধু নির্মাণ নয়, বরং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা।

বাংলাদেশ একটি তরুণ দেশ। প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে স্বপ্ন নিয়ে। যদি তাদের গবেষণার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তারা প্রশ্ন করতে শিখবে, ভাবতে শিখবে, সমাধান তৈরি করতে শিখবে। এই দক্ষতাগুলোই একটি সমাজকে উদ্ভাবনী, মানবিক ও সহনশীল করে তোলে। অন্যদিকে, যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু পরীক্ষার জন্য মুখস্থ করানোর কেন্দ্র হয়, তাহলে আমরা ডিগ্রিধারী পাব, চিন্তাবিদ নয়।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে সে দারিদ্র্য দূর করতে পারে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, এবং অবকাঠামো গড়তে পারে। এখন সময় জ্ঞান দিয়ে পথচলার। গবেষণা আর বিলাসিতা নয়, বরং জাতি গঠনের কেন্দ্রবিন্দু। এ সত্য যত দ্রুত বুঝে রাষ্ট্র গবেষণায় বাজেট ও মনোযোগ দেবে, ততই শক্তিশালী হবে আমাদের ভবিষ্যৎ।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন পাঠদানের জায়গা থেকে চিন্তা সৃষ্টির প্ল্যাটফর্মে পরিণত করতে হবে। গবেষণাকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, সামাজিক সম্মান এবং তরুণদের প্রেরণার কেন্দ্রে আনতে না পারলে আমরা ভবিষ্যতের বিশ্বে শুধু দর্শক হয়েই থাকব। এখনো সময় আছে, গবেষণার নীরবতাকে শব্দে রূপ দিতে হবে। সেই শব্দই হতে পারে আমাদের নতুন অগ্রযাত্রার সূচনা।