ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৫

সম্পাদকীয়

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২৫, ০২:২৬ এএম

রাজধানী ঢাকা সম্প্রতি এক আতঙ্ক ও অনিশ্চিত পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের মাত্র দশ মাসে নগরীতে ৩৭১টি হত্যাকা- হয়েছে। এই পরিসংখ্যান কোনোভাবেই স্বাভাবিক বা সহনীয় নয়। ডিএমপির দাবি হত্যার নৃশংসতা, খোলামেলা গুলি, প্রকাশ্য খুন ও সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া কর্মকা-ের মধ্যেই প্রতিফলিত হচ্ছে। নগরীতে প্রতিদিন মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ঘরে-বাইরের প্রতিটি পদক্ষেপে ভর করছে অনিশ্চয়তা।

বিশেষত সাম্প্রতিক যে ধারাবাহিক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে, পল্লবীতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে দোকানে ঢুকে ফিল্মি স্টাইলে গুলি করে হত্যা, পুরান ঢাকায় তারিক সাইফ মামুনকে আদালত থেকে বের হয়ে আসার মুহূর্তে গুলি, গুলশান ও মোহাম্মদপুরে রাজনৈতিক ক্যাডারদের লক্ষ্য করে পৈশাচিক আক্রমণ এসব ঘটনা প্রমাণ করে নগরীর নিরাপত্তা বলয় কতটা ভঙ্গুর। চোরাই পথে আসা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা মুখোশ, হেলমেট পড়ে এখন আরও সাহসী। কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই তারা মিনিটের মধ্যে হত্যাকা- ঘটিয়ে নির্বিঘেœ পালিয়ে যাচ্ছে। এটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। বরং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার বড় ধরনের ব্যর্থতারই প্রতিফলন।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অপরাধীরা ধরা পড়লেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব, আন্ডারওয়ার্ল্ডের আধিপত্য, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে হত্যাকা-ের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও পরিকল্পনাকারীরা বারবার রক্ষা পাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, অপর্যাপ্ত গোয়েন্দা নজরদারি এবং গ্রেপ্তারকৃত সন্ত্রাসীদের সহজে জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসা, সবকিছু মিলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশ যেভাবে নতুন পথের সন্ধানে রয়েছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতা যে কতখানি অস্থিরতা তৈরি করতে পারে তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো সম্প্রতি এই খুনাখুনি। গণ-অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া ১ হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এটি ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় হুমকি। নির্বাচনের সামনে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সক্রিয়তা আরও বাড়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।  বিদেশে থাকা মাফিয়ারা নতুন করে শক্তি জোগাড়ের চেষ্টা করছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীর মধ্যে ভয়হীনতার বোধ সৃষ্টি হলে অপরাধের মাত্রায় নৃশংসতা বাড়ে। নিজেদের ক্ষমতা আর প্রভাবের জানান দিতে অপরাধীরা এ ধরনের নৃশংসতা ছড়ায়। এসব ভয়াবহতা ঠেকাতে হলে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। একটা সমাজে যত বেশি অবৈধ অস্ত্র থাকবে, তত বেশি অপরাধের ঝুঁকি থাকবে।’ নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে জোরালো বিশেষ অভিযান প্রয়োজন।

এ বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী, সুসংগঠিত ও জোরালো আইনশৃঙ্খলা কৌশল। শুধু ঘটনাস্থলে তদন্ত বা খ- খ- গ্রেপ্তার যথেষ্ট নয়। মূল হোতাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালাতে হবে।  সিসিটিভি নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে দক্ষতা বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে। কারণ অপরাধ দমন তখনই সফল হবে যখন অপরাধী যেই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ হবে সমানভাবে।

এ পরিস্থিতিতে,  সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাদক, সন্ত্রাস ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ ও সচেতনতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সমাজ যখন অপরাধের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে, তখন আইন প্রয়োগ করাও সহজ হবে।

আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, অপরাধ দমনে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সমাজ এই তিনটি স্তরকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সন্ত্রাসী কর্মকা-, প্রকাশ্য গুলি, হত্যাকা- যেকোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার। এ ধারাকে যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে রাজধানীসহ সারাদেশ গভীর অস্থিরতার দিকে এগোবে। তাই দেরি না করে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়। এটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার পূর্বশর্ত।