সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি দেশ হলেও এর বাণিজ্যিক রাজধানী দুবাইয়ের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম উন্নত এই বাণিজ্যিক নগরীই ইউএই-কে আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দিয়েছে। সে কারণে, অনেকেই ইউএই-এর পরিবর্তে দুবাই গমনের কথা বলে থাকেন। ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি আকাশপথে যাতায়াত বা ট্রানজিটের কেন্দ্র হিসেবেও ভালো মুনাফা অর্জন করছে। প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে এক্সপো ২০২০-এর মতো আন্তর্জাতিক আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করে দুবাই তার বাণিজ্যিক সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। সেই সময় বাংলাদেশিরাও গণহারে ভিসা পেয়েছিল। তবে সাধারণ শ্রমিকদের জন্য ভিসা বরাবরই সীমিত ছিল।
প্রায় এক যুগ ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাধারণ শ্রমিকদের জন্য ভিসা বন্ধ রয়েছে। ২০১২ সালে অপরাধ প্রবণতার কারণে বাংলাদেশিদের ভিসা সীমিত করা হয়। তবে ভিসা বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ থেকে লোকজন আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। গত এক দশকে বিভিন্ন উপায়ে বহু বাংলাদেশি আমিরাতে প্রবেশ করেছেন। জানা গেছে, কেউ কেউ ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করেও এসেছেন। এ ছাড়া, ভিজিট ভিসায় এসে অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার ঘটনাও অনেক।
পর্যটন শিল্প বহু দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এটি দ্র”ত বিকাশমান একটি খাত, যা কর্মসংস্থান তৈরি করে এবং দেশকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে। ইউএই-তেও পর্যটনকেন্দ্র বাড়ছে এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের জন্য সাধারণ ভিসা বন্ধ, তবে বাণিজ্যিক কারণে পর্যটন ভিসা সহজ রাখা হয়েছে। শুরুর দিকে সরকারি কর্মকর্তাদেরও দুবাই আসতে জটিলতায় পড়তে হতো।
দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক পরিবেশ, দুর্নীতি এবং বেকারত্বের কারণে যুবসমাজ বিদেশে যেতে আগ্রহী। ইউরোপের ভিসা পাওয়া কঠিন
হওয়ায় অনেকে এখন মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও মালয়েশিয়ায় যেতে চাইছে। সেক্ষেত্রে দুবাই অনেকেরই পছন্দের গন্তব্য। সাধারণ ভিসা বন্ধ
থাকায় ট্যুরিস্ট ভিসাই ছিল একমাত্র ভরসা। ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে অনেকে বৈধ হয়েছেন, আবার অনেকে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। গত বছর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সবাইকে বৈধ হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেই সুযোগে অনেকে বৈধতা পেয়েছেন, কেউ দেশে ফিরে গেছেন, আবার অনেকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি।
যারা ভিজিট ভিসায় এসে বা ইনভেস্টর ভিসা নিয়ে দুবাইয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন, তাদের অবস্থাও খুব সুবিধাজনক নয়। যৌথভাবে ইনভেস্টর ভিসা পেতে একজনের প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো খরচ হতো, কারো আরও বেশি বা কম। দুঃখের বিষয় হলো, অনেকেই ইনভেস্টর ভিসায় থাকলেও কার্যকরভাবে ব্যবসা করছেন না। অনেকে শুধু নামে মাত্র লাইসেন্স ও অফিস ভাড়া নিয়ে ভিসা নিচ্ছেন। এমন বেশ কিছু সিন্ডিকেট গ্রুপ আছে যারা দেশ থেকে কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে লোক এনে শুধু ইনভেস্টর ভিসা লাগানোর কাজ করে।
এই সিন্ডিকেটগুলো বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিলেও কাজের কোনো সুযোগ দিচ্ছে না। যারা নিজেদের উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করেছেন বা পরিবারের কোনো সদস্যের ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন, তাদের কথা ভিন্ন। বর্তমান সময়ে আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক বাজার কেমন, তা কেবল এখানে বসবাসকারী ব্যবসায়ীরাই বলতে পারেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করে ইনভেস্টর ভিসা নিয়েও অনেক প্রবাসী সুবিধামতো কাজ না পেয়ে একপর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়েন। কাগজপত্রে একজন ব্যবসায়ী হয়েও অনেকে ভাঙারি ব্যবসায়ীর অধীনে কাজ করছেন, যা বৈধ নয়। পুলিশ যদি আইডি যাচাই করে এবং দেখে যে একজন ব্যবসায়ী হয়েও ক্যান কুড়াচ্ছেন, তখন পরিস্থিতি কী হবে? এত টাকা খরচ করে বৈধ হওয়ার পরও তারা একরকম অবৈধ জীবনই কাটাচ্ছেন।
ভিজিট ভিসা ও ইনভেস্টর ভিসার অপব্যবহারের পাশাপাশি আরেকটি বড় সমস্যা হলো জাল সার্টিফিকেট। যখন থেকে আমিরাত সরকার দক্ষ ও শিক্ষিত কর্মী নিয়োগের জন্য ভিসা নীতি পরিবর্তন করলো, তখন থেকে জাল সার্টিফিকেটধারী কর্মীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। খবরটি আশাব্যঞ্জক হলেও বিব্রতকর পরিস্থিতি হলো, অনেক শিক্ষিত কর্মীই জাল সার্টিফিকেট ব্যবহার করে ভিসা নিয়ে এসেছেন। উচ্চপদের চাকরির ভিসা নিয়ে এসে তারা কনস্ট্রাকশন শ্রমিক বা হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন।
স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানে আটক হওয়া অনেক প্রবাসীর আইডি যাচাই করলে দেখা যায়, ম্যানেজার, সেলস অফিসার, মার্কেটিং অফিসার, বা এক্সিকিউটিভ অফিসার পদের ভিসাধারীরা কনস্ট্রাকশন লেবার, হেল্পার, ডেলিভারিম্যান বা ওয়েটারের কাজ করছেন।
একবার বিশ্ব সরকার সম্মেলন থেকে ফিরে এসে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘ভিসা খোলার ব্যাপারে কী সুপারিশ করব। আমাদের কোনো ডকুমেন্ট আমিরাত সরকার বিশ্বাস করতে পারে না, এতটা ভুয়া। বাড়ির কাজের লোক অথচ সে মেডিকেল ডক্টরের সার্টিফিকেট নিয়ে গেছে। আর কতজনকে তারা যাচাই করবে? লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়!’
আমাদের নিজেদের মানুষের কর্মকা-ে আসলেই আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তার আগে আমাদের আত্মশুদ্ধি জরুরি। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রেসক্লাব, ইউএই-এর এক গোলটেবিল বৈঠকে আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদ আমিরাত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, দেশটির সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক অনেক গভীর। তিনি প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন তাদের কর্মক্ষেত্রে সুন্দর আচরণ ও সম্মানের সঙ্গে কাজ করে দেশের সম্মান বজায় রাখেন।
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আত্মশুদ্ধি। নিজেকে নিজে আইনকানুনসহ প্রত্যেকটা বিষয়ে শুধরে নিলে অনেকাংশে অপরাধ কমে আসবে।’ একইসঙ্গে তিনি উল্লিখিত সমস্যার সমাধান ও তার বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। এ ছাড়া, তিনি অনুকূল বা প্রতিকূল সব পরিস্থিতিতে আমিরাতের আইন মেনে চলতে প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ জানান। আমরা রাষ্ট্রদূতের এই আহ্বানকে বাস্তবে কার্যকরী হিসেবে দেখতে চাই এবং
ভিসা সমস্যার একটি দৃশ্যমান সমাধান কামনা করি।
লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই