ঢাকা সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

স্বপ্নের প্রবাস নাকি নিঃস্ব জীবন

আরফান হোসাইন রাফি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ০১:৪৫ এএম

প্রকৃতির উথাল-পাথাল হাওয়ায় যখন জীবনচক্র বিপন্ন প্রায় তখন বিদেশে গিয়ে ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন দেখেন গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত  হাজারো তরুণ। কিন্তু দেখা যায়, এই স্বপ্নের ডানায়ই ভর করে এগিয়ে আসে দালালচক্রের এক ভয়ংকর ছায়া। চটকদার কথায়, মিষ্টি আশ্বাসে আর রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে ফেলে। কেউ ভিটেমাটি বিক্রি করে, কেউ ঋণ করে কিংবা সঞ্চয় ভেঙে দালালের হাতে টাকা তোলে। অথচ এই বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। দালালদের প্রতারণার ধরন প্রায় একই রকম। প্রথমে বিদেশে ভালো বেতনের কাজের প্রলোভন, তারপর দ্রুত ভিসার আশ্বাস। দেখানোর জন্য থাকে নকল কাগজপত্র, মিথ্যা নিয়োগপত্র বা সাজানো চুক্তি। মানুষ তখন বিশ্বাস করে বসে, ভাবতে থাকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সব ঋণ শোধ হবে, সংসারে সুখ ফিরবে। কিন্তু বাস্তবতা হয় উল্টো।

অনেক সময় বিমানবন্দরে গিয়ে বোঝা যায়, ভিসা ভুয়া কিংবা কাগজপত্র অকার্যকর। কেউ বা পৌঁছালেও দেখে প্রতিশ্রুত চাকরি নেই, বরং অমানবিক পরিশ্রমে ঠেলে দেওয়া হয়। অন্যদিকে প্রতারণার আরেক চিত্র হলো জিম্মি করে রাখা। অনেককে বিদেশে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয় নির্দিষ্ট স্থানে। তখন তাদের পরিবারের কাছে ফোন যায় যে, ‘মুক্ত করতে হলে আরও কয়েক লাখ টাকা দিতে হবে।’ অসহায় পরিবারগুলো আবারও ঋণের ফাঁদে পড়ে। ফলে যিনি বিদেশে গেছেন তিনি যেমন নিঃস্ব হন, তেমনি তার স্বজনরাও পড়ে যায় গভীর সংকটে। এই দালাল চক্র শুধু আর্থিক ক্ষতি করছে না; ধ্বংস করছে পরিবার ও সমাজের স্থিতি। ঋণের বোঝা বইতে না পেরে অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। কেউ কেউ হতাশায় জীবন শেষ করে দিচ্ছে। আর দেশের অর্থনীতি থেকেও পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তাই এইসব প্রতারণের ফাঁদে পড়ার আগেই আমাদের জেনে রাখা উচিত প্রতারকদের উৎস বিভিন্ন কৌশল, প্রভাব এবং উত্তরণের পথ সম্পর্কে।

প্রতারকদের উৎস

প্রতারকদের উৎস সাধারণ আমাদের আশপাশের মানুষের মধ্য থেকেই হয়। সেটা হতে কাছের বন্ধু কিংবা কোনো আত্মীয়। তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের মিষ্টি আশ্বাস। তারা সাধারণ মানুষকে বোঝায় ‘দুবাইয়ে গেলে মাসে ষাট হাজার টাকা আয় হবে’, ‘মালয়েশিয়ায় গিয়ে সহজ কাজ করতে হবে’, কিংবা ‘ইউরোপে পাঠালে এক বছরের মধ্যেই ভাগ্য খুলে যাবে।’ এসব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে থাকে চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র, সাজানো কাগজপত্র বা নকল ভিসা।

তখন বিদেশযাত্রার স্বপ্নে বিভোর মানুষ তখন পরিবারের সঞ্চয়, ভিটেমাটি বিক্রি কিংবা ধার-দেনার টাকা তুলে দেয় দালালের হাতে। বাস্তবে দেখা যায়, বিমানবন্দরে পৌঁছে কাগজপত্র জাল বলে ধরা পড়ে যায়। অনেককে গ্রেপ্তার হতে হয়, অনেকের যাত্রা ব্যর্থ হয় সেখানেই। আবার যাদের বিদেশে পৌঁছানো হয়, তাদের জন্য অপেক্ষা করে আরেক দুঃস্বপ্ন। প্রতিশ্রুত চাকরির বদলে দেওয়া হয় অন্য কাজ। কেউ হালকা চাকরির আশায় গেলেও তাকে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে ১২-১৪ ঘণ্টা অমানবিক পরিশ্রমে ঠেলে দেওয়া হয়। খাবার অপ্রতুল, মজুরি সামান্য। অনেকেই বুঝতে পারে, স্বপ্নের দেশে তারা যেন বন্দি জীবন কাটাচ্ছে।

দালালদের কৌশল

দালাল চক্র তাদের প্রতারণায় নানা কৌশল ব্যবহার করে। কেউ ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে বলে ‘বিদেশে গেলে হজ বা ওমরাহ করতে পারবে।’ আবার কেউ বলে ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দ্রুত ভালো চাকরি পাওয়া যাবে।’ কখনো প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহার করে বিশ্বাস অর্জন করে। গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল মানুষ এসব কথায় সহজেই ফাঁদে পড়ে যায়। দালালরা খুব কমই সরাসরি কাজ করে। তারা সাধারণত একটি চেইনের মতো গড়ে ওঠে! উপরের দালাল, নিচের দালাল, মাঝে দালাল। ফলে এক একজন মানুষ প্রতারণার শিকার হলে আসল অপরাধীকে ধরাই কঠিন হয়ে পড়ে। এই চক্রটি এতটাই প্রভাবশালী যে, অনেক সময় আইনের ফাঁক গলে তারা বেঁচে যায়।

প্রতারণার প্রভাব

প্রতারণার ফাঁদে পা দিলে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের উপরও। দালালদের প্রতারণার সবচেয়ে নৃশংস রূপ হলো জিম্মি করা। বিদেশে নিয়ে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট স্থানে আটকে রেখে তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে মোটা অংকের টাকা দাবি করে ফলে পরিবারে পরিবারের ভাঙন সৃষ্টি হয়। যে পরিবার বিদেশে পাঠানোর আশায় ঋণ করে বা সঞ্চয় ভাঙে, তাদের স্বপ্ন ভেঙে যায় কয়েক মাসের মধ্যেই। বিদেশে যাওয়া সদস্যটি যদি কাজ না পায় বা ফিরে আসতে বাধ্য হয়, তখন সংসার দাঁড়িয়ে যায় চরম অনিশ্চয়তার মুখে। শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, নারীরা সংসার চালাতে হিমশিম খায়, বয়স্করা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। একসময় পরিবারের ভাঙন শুরু হয়, অনেকে হতাশায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আবার কিছুক্ষেত্রে সামাজিক প্রভাবও লক্ষণীয়। অসংখ্য তরুণ যখন প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে আসে, তারা হয়ে ওঠে বেকার ও হতাশ। ঋণের বোঝা আর সামাজিক লজ্জা তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বছরে কোটি কোটি টাকা বৈধ পথে না গিয়ে দালালদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। যা দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে কাজে লাগতে পারত, তা চলে যায় অসাধু লোকজনের হাতে। ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্র একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কেন মানুষ দালালের ফাঁদে পা দেয়

সবাই জানে, বিদেশ যাওয়া সহজ কাজ নয়। তবুও কেন এত মানুষ দালালের ফাঁদে পড়ে? এর প্রধান কারণ হলো হতাশা ও অভাব। দেশে বেকারত্ব, সীমিত কাজের সুযোগ, দারিদ্র্য মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। যখন কেউ বলে ‘অল্প টাকায় বড় কাজ হবে’, তখন মানুষ ঝুঁকি নিতেই রাজি হয়। পরিবারের চাপ, স্বজনদের প্রত্যাশা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছাও মানুষকে দালালের প্রলোভনে টেনে আনে।

উত্তরণের পথ

দালালদের প্রতারণা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বিদেশে কর্মসংস্থানের বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে সচেতনতা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। প্রতিটি গ্রামে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা প্রকাশ ও সহজলভ্য করা দরকার। বিদেশগামীদের জন্য প্রশিক্ষণ, সঠিক কাগজপত্র যাচাইয়ের ব্যবস্থা এবং স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি দালাল চক্রকে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সচেতনতা। পরিবারগুলোকে বুঝতে হবে, অল্প টাকায় বড় সুযোগের লোভে না পড়া। স্বপ্ন দেখতে হবে, তবে সে স্বপ্ন হতে হবে বাস্তবসম্মত। দালালের ফাঁদে না পা দিলে কেবল ব্যক্তি নয়, সমাজ ও দেশও রক্ষা পাবে ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে।