অভাব-অনটন কিংবা সামান্য সুখের আশায় অনেকেই বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। অর্থনৈতিক সংকট লাঘবের সহজ উপায় ভেবে অনেকে তাড়াহুড়ো করে বিদেশগমনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় নিয়ম–কানুন না জেনে এ পথে পা বাড়ালে সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ফলে কখনো বিমানবন্দরে, আবার কখনো বিদেশে পৌঁছানোর পরও নানা জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি অনেক অর্থ ব্যয় করেও কাউকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।তাই বিদেশে যাওয়ার আগে পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন মিনহাজুর রহমান নয়ন।
নাম নিবন্ধন
কর্মজীবী হয়ে বিদেশ যেতে বাধ্যতামূলকভাবে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি অফিসের অনলাইন ডেটাবেজ নেটওয়ার্কে নাম নিবন্ধন করতে হয়। তবে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস বা ডেমো অফিস থেকে সংগৃহীত নাম নিবন্ধন ফর্ম পূরণ করে সেখানকার নিবন্ধন সেবা কর্মকর্তার মাধ্যমেও নাম নিবন্ধন করতে পারবেন। নাম নিবন্ধন শেষে আপনি জবসিকার্স তবে মনে রাখবেন, শুধুমাত্র কার্ড বা এমপ্লয়ই রেজিস্ট্রেশন কার্ড হাতে পাবেন। তবে মনে রাখবেন, শুধু নাম নিবন্ধন চাকরির নিশ্চিয়তা দেয় না। নিচে কিছু লিংক দেওয়া হলো, যেগুলো ব্যবহার করে অনলাইনে নাম নিবন্ধনের প্রক্রিয়াসহ নাম নিবন্ধন ফর্ম পূরণের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি সহজভাবে বুঝতে পারবেন।
নাগরিক ও জন্মসনদ তৈরি
কাজের জন্য বিদেশ যেতে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি ডাটাবেজে নাম নিবন্ধন করার সময় আপনার নাগরিক সনদপত্র ও পাসপোর্ট তৈরির সময় জন্মসনদ প্রয়োজন হবে। তাই আগে থেকেই আপনার নাগরিক সনদপত্র ও জন্মসনদ তৈরি করে রাখুন।
নাগরিক সনদপত্র পেতে করণীয়
নাগরিক সনদপত্র পাওয়ার জন্য আপনি যে এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা সে এলাকার ইউনিয়ন/পৌরসভা/ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। নাগরিক সনদপত্র পেতে ইউনিয়নের ক্ষেত্রে খরচ ৫ টাকা, পৌরসভার ক্ষেত্রে খরচ ১০ টাকা।
জন্ম সনদপত্র পেতে করণীয়
জন্ম সনদপত্র পেতে আপনার এলাকার ইউনিয়ন/পৌরসভা/ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিসে যেতে হবে। এ সনদপত্রের জন্য সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে নির্দিষ্ট আবেদনপত্র সংগ্রহ এবং পূরণ করে জন্মনিবন্ধন করতে হবে। নাগরিক সনদপত্রের মতো এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট অফিসের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। জন্মনিবন্ধন শেষে জন্মসনদ নেওয়ার জন্য খরচ, বয়স ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে হলে ৫০ টাকা এবং ১৮ বছরের নিচে কোনো খরচ নেই। ইউনিয়ন/পৌরসভা/ ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস থেকে সংগ্রহ করা জন্মসনদের আবেদনপত্রটিতে আপনার সব তথ্য হাতে লিখে পূরণ করে জমা দিতে হবে।
পাসপোর্ট তৈরি
পাসপোর্ট হলো বিদেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত একটি পরিচয়পত্র। পাসপোর্ট না থাকলে আপনি কখনো বিদেশে যেতে পারবেন না। পাসপোর্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার আপনাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেন। পাসপোর্ট অফিস ও যারা বিদেশে রয়েছেন তারা বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রত্যেকটি দূতাবাসের মাধ্যমে ই-পাসপোর্ট করাতে পারবেন।
ভিসা সংগ্রহ ও যাচাই
আপনি যে মাধ্যমে (বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি, বোয়েসেল বা বিএমইটি) বিদেশে চাকরির ব্যবস্থা করছেন তারা আপনার জন্য ওয়ার্কিং ভিসা বা কাজের ভিসা সংগ্রহ করে দেবে। এক্ষেত্রে ভিসা আবেদনের পর নিজ দায়িত্বে ভিসার ব্যাপারে রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখতে হবে। ভিসা হাতে পেলে, ভিসা চেকিং একটি জরুরি বিষয়। আপনার ভিসাটি সঠিক কিনা তা যাচাই করে দেখাকেই ভিসা চেকিং বা পরীক্ষা করা বলা হয়। ভিসা চেকিং (ভিসা সঠিক কিনা তা যাচাই) বা পরীক্ষার জন্য আপনাকে ঢাকায় অবস্থিত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি অফিসের ওয়ানস্টপ সার্ভিস ডেস্ক- থেকে সহায়তা নিতে হবে।
তবে ইন্টারনেটের সাহায্যে কয়েকটি
দেশের ভিসা চেকিং আপনি নিজেই করতে পারবেন। আপনার এলাকা বা তার কাছাকাছি যেকোনো ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র, পল্লি তথ্যকেন্দ্র বা ইন্টারনেট সংযোগ আছে এমন কোনো সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে তথ্যকর্মীর সহায়তা নিয়ে ভিসা চেকিং করতে পারেন। নি¤েœ কয়েকটি দেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেওয়া হলো যেগুলোর সাহায্যে অন-লাইনের মাধ্যমে আপনি নিজের ভিসা নিজে পরীক্ষা করতে পারবেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউ.এ.ই)-এর ভিসা চেক করার ঠিকানাটি হলো: যঃঃঢ়://িি.িসড়ষ.মড়া.ধব কাতার-এর ভিসা চেকিং ঠিকানাটি হলো: যঃঃঢ়://িি.িসড়র.মড়া.য়ধ
চাকরির চুক্তিপত্র
কর্মজীবী হয়ে বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে চাকরির চুক্তিপত্র হাতে পাওয়ার পর তা আসল কি-না তা পরীক্ষা করে নেওয়া এবং এতে উল্লেখিত সকল বেতন-ভাতা, অন্য শর্ত ও সুবিধাদি বুঝে নিয়ে স্বাক্ষর করা বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে একটি প্রয়োজনীয় ধাপ। চুক্তিপত্র ছাড়া কোন চাকরি করলে নিয়োগকর্তা আপনার সঙ্গে নিয়মের বাইরে কাজ করাতে চাইলে কোনো আইনত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না বিধায় যেকোনো চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে চুক্তিপত্র বুঝে নিয়ে তবেই স্বাক্ষর করা খুবই জরুরি। আপনি যে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে চাকরির আবেদন করেছেন তারাই আপনাকে চাকরির চুক্তিপত্র পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। তবে আপনি যদি কোনো থার্ড পার্টির (বন্ধু বা পরিচিত কেউ বা আত্মীয়) মাধ্যমে চাকরির ব্যবস্থা করে থাকেন তাহলে সে ব্যক্তির কাছ থেকে চুক্তিপত্র হাতে পাবেন। তবে থার্ড পার্টি দিয়ে চাকরির ব্যবস্থা না করাই। আপনি যে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে চাকরি পাবেন তারাই আপনাকে চুক্তিপত্র সত্যায়িত করার ব্যবস্থা করে দেবে। ঢাকায় অবস্থিত জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি অফিসের ওয়ানস্টপ সার্ভিস ডেস্ক থেকে চুক্তিপত্র চেকিং-এর সেবা বিনা খরচে দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ সেবা পেতে ‘বায়রা’ (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি) অফিসেও যোগাযোগ করতে পারেন।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তৈরি
দেশে বৈধভাবে টাকা পাঠানো এবং অর্জিত টাকা সঠিকভাবে সঞ্চয় করার জন্য কর্মজীবী হিসেবে দেশ ছাড়ার আগে আপনাকে অবশ্যই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তৈরি করবেন। একটি অ্যাকাউন্ট যৌথ নামে অর্থাৎ আপনি এবং আপনার পরিবারের বিশ্বস্ত সদস্যের নামে। এ যৌথ অ্যাকাউন্টে আপনি শুধু আপনার পরিবার চালানোর খরচ বা তার থেকে সামান্য বেশি অর্থ পাঠাবেন। আর একটি অ্যাকাউন্ট খুলবেন নিজের নামে। আপনি বিদেশে কাজ করে উপার্জিত অর্থ থেকে আপনার পরিবার পরিচালনার খরচ পাঠানোর পর, বিদেশে আপনার চলার খরচ শেষে যদি বাড়তি কিছু অর্থ থাকে তাহলে সেটা নিজের নামের অ্যাকাউন্টে জমা করবেন।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা
কর্মজীবী হিসেবে বিদেশ যেতে বৈধ ভিসা পেতে ওই দেশের দূতাবাস দ্বারা নির্ধারিত মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা মেডিকেল টেস্ট করা একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া। কর্মী হিসেবে বিদেশে যেতে ভিসা ও চুক্তিপত্রের জন্য অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ফলাফলের কাগজ জমা দিতে হয়। উল্লেখ্য, বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি শেষে পাসপোর্ট, ভিসা ও চাকরির চুক্তিপত্র হাতে পাওয়ার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়। নিয়োগকারী দেশ অর্থাৎ আপনি যে দেশে কাজ করতে যাচ্ছেন সে দেশের স্ব-স্ব দূতাবাস কর্তৃক নির্ধারিত মেডিকেল সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া আপনি আপনার স্থানীয় এলাকার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ফলাফল সনদ সংগ্রহকরতে পারবেন।
মেডিকেল সেন্টারে কুপন দেখিয়ে টাকা জমা করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়। পরীক্ষার ফলাফল কবে, কখন পাবেন তা মেডিকেল সেন্টার থেকে জানাতে হয়। আপনি যে দেশে কাজ করতে যাচ্ছেন সে দেশের দূতাবাসের গেটে গিয়ে কাজের ভিসা ও চুক্তিপত্র দেখিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কুপন সংগ্রহ করতে হবে। এ ছাড়া রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সাধারণত বিদেশ অভিবাসী চাকরিপ্রার্থীদের জন্য কুপন সংগ্রহ সহ স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে থাকে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে ২,১০০/- টাকা খরচ হয়। তবে এ খরচ বিদেশ যাওয়ার জন্য নির্ধারিত ২০,০০০/- টাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যে বিষয়গুলো দেখা হয়
রক্ত পরীক্ষা:
এইচএসবিএসজি, হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘বি’, ভিডিআরএল (যৌনরোগ/সংক্রমণ পরীক্ষা), এইচআইভি (এইডস-এর পরীক্ষা), টিউবারকিউলোসিস (যক্ষ্মার পরীক্ষা), ম্যালেরিয়া, লেপ্রোসি, মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভবতী কিনা ইত্যাদি বিষয়ের পরীক্ষা করা হয়।
বিএমইটির ব্রিফিং-এ অংশগ্রহণ
কর্মজীবী হিসেবে বিদেশ যাওয়ার পূর্বে ঢাকায় অবস্থিত জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি অফিসে পরিচালিত ব্রিফিং সেশনে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক কাজের মধ্যে একটি। এই ব্রিফিং সম্পন্ন না করলে বিএমইটি থেকে স্মার্টকার্ড বা ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড দেওয়া হয় না। বিএমইটি অফিসে এক্সটেনশন বিল্ডিং-এর দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ব্রিফিং সেন্টারে প্রতিদিন (ছুটির দিন বাদে) ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিফিং শেষে ব্রিফিং রুম থেকে আপনার পাসপোর্টে ব্রিফিং সম্পন্ন হয়েছে, এই মর্মে একটি সিল দেয়া হবে। স্মার্টকার্ড তোলার সময় ব্রিফিং সিল সংবলিত আপনার পাসপোর্টটি প্রয়োজন হয়।
স্মার্টকার্ড বা ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড
কর্মজীবী হিসেবে বিদেশ যেতে আপনাকে বাধ্যতামূলকভাবে বিএমইটি থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হবে। আপনি যে বাংলাদেশ থেকে কর্মী হিসেবে অন্য দেশে যাচ্ছেন তার আনুষ্ঠানিক সরকারি স্বীকৃতি হলো এই বহির্গমন ছাড়পত্র বা ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড। এটি এক ধরনের কম্পিউটার চিপ সংযুক্ত কার্ড, যেখানে একজন কর্মী হিসেবে আপনার যাবতীয় তথ্য যেমন: আপনার পাসপোর্টের তথ্য, আঙ্গুলের ছাপ, আপনি যে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কাজ পেয়েছেন তাদের লাইসেন্স নম্বর ইত্যাদি দেয়া থাকে। স্মার্টকার্ড হাতে পেতে দুটি প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের নমুনা সংবলিত লিংক নি¤েœ দেওয়া হলো:
অঙ্গীকারপত্র:
অনলাইন থেকে অঙ্গীকারপত্র সংগ্রহ করে কম্পিউটারের মাধ্যমে নিজের সব তথ্য দিয়ে ফর্ম পূরণ করে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প কাগজে প্রিন্ট করতে হবে এবং স্বাক্ষর করে সংশ্লিষ্ট অফিসে জমা দিতে হবে।
অনাপত্তিপত্র:
অনলাইন থেকে একটি অনাপত্তিপত্র সংগ্রহ করে কম্পিউটারের মাধ্যমে নিজের সব তথ্য দিয়ে ফর্ম পূরণ করে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প কাগজে প্রিন্ট করতে হবে এবং স্বাক্ষর করে সংশ্লিষ্ট অফিসে জমা দিতে হবে।
দরখাস্ত (স্মার্টকার্ডে ভুল সংশোধনের জন্য):
অনলাইন থেকে একটি দরখাস্ত সংগ্রহ করে কম্পিউটারের মাধ্যমে নিজের সব তথ্য দিয়ে ফর্ম পূরণ করে প্রিন্ট করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট অফিসে জমা দিতে হবে।