দীর্ঘ সাত দশকের পুরোনো কাফালা বা পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবস্থা অবশেষে ইতিহাস হতে যাচ্ছে সৌদি আরবে। আগামী বছরের প্রথমার্ধেই কার্যকর হবে নতুন চুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থান ব্যবস্থা, যা দেশটির দশ লাখেরও বেশি অভিবাসী কর্মীর জীবনে বড় পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যুগান্তকারী সংস্কারের ঘোষণা
সৌদি মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চলতি মাসের মধ্যেই কাফালা ব্যবস্থা বাতিলের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসছে। নতুন নীতিতে প্রবাসীরা নিজ উদ্যোগে এক্সিট ও রি-এন্ট্রি ভিসা নিতে পারবেন, পাসপোর্টে চূড়ান্ত প্রস্থান
সিলের জন্য আর পৃষ্ঠপোষকের অনুমতি লাগবে না।এ ছাড়া, কর্মচুক্তির মেয়াদ ও শর্ত অনুযায়ী তারা স্বাধীনভাবে কর্মস্থল পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন।
সাত দশকের কাফালা ব্যবস্থা
কাফালা ব্যবস্থায় এতদিন একজন কর্মীর ভিসা, বাসস্থান ও চাকরির আইনি দায়ভার ছিল নিয়োগকর্তার হাতে।
ফলে কর্মীরা চাকরি পরিবর্তন, দেশে ফেরা কিংবা ভিসা নবায়নের মতো বিষয়েও নিয়োগকর্তার অনুমতির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন। এই কারণে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার কাফালা ব্যবস্থাকে ‘শোষণমূলক’ বলে আখ্যা দিয়েছে। প্রায় ৭০ বছর ধরে প্রচলিত এই ব্যবস্থায় বিদেশি কর্মীদের ভিসা, বাসস্থান, কর্মসংস্থানের আইনি দায়ভার। ফলে কর্মীরা নিজের সিদ্ধান্তে চাকরি পরিবর্তন, দেশে ফেরা বা ভিসা নবায়নের সুযোগ পেতেন না। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বরাবরই একে শোষণমূলক’ ও ‘অমানবিক’ বলে সমালোচনা করেছে।
পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট
এই সংস্কার সৌদি আরবের ‘ভিশন ২০৩০’ কর্মসূচির অংশ। অর্থনীতি বৈচিত্র্যকরণ, জীবনমান উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে চালু হওয়া ‘প্রিমিয়াম ইকামা’ বা স্পেশাল প্রিভিলেজ রেসিডেন্সি পারমিট-এর মাধ্যমে বিদেশিদের বসবাস, সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক সুযোগ দেওয়ার পর এবার কাফালা বিলুপ্তি সেই ধারাবাহিকতার পরবর্তী ধাপ।
নতুন ব্যবস্থায় কী বদলাবে
নতুন নীতিমালায় কর্মীরা নিজেরাই এক্সিট ও রি-এন্ট্রি ভিসা নিতে পারবেন। চাকরি পরিবর্তনের আগে নির্দিষ্ট চুক্তির শর্ত পূরণ করতে হবে। পাসপোর্ট নিয়োগকর্তার কাছে জমা রাখতে হবে না। নিয়োগকর্তা ও কর্মীর সম্পর্ক আসবে আইনি কাঠামোর আওতায়। ফলে, প্রবাসীরা পাবেন বেশি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা, আর নিয়োগকর্তারা পাবেন স্বচ্ছ শ্রমনীতি।
কী নতুন আসছে
প্রিমিয়াম ইকামা বা সুনামের সঙ্গে বলা হয় ‘প্রিভিলেজ রেসিডেন্সি পারমিট’ এটি একটি বিশেষ ধরনের স্থায়ী বা দীর্ঘ মেয়াদি বাসস্থান অনুমোদন যা বিদেশিদের দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা সৌদি আরবে স্বাধীনভাবে বসবাস, কাজ, ব্যবসা ও সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারেন। মূল উদ্দেশ্য হলো ভিশন ২০৩০-এর অংশ হিসেবে বিদেশি দক্ষ ও বিনিয়োগকারী শ্রমিক, উদ্যোক্তা ও উচ্চ-মানের পেশাদারদের আকর্ষণ করা।
যারা আবেদন করতে পারবেন
আবেদনের নিয়ম:
- আবেদনকারীর কাছে একটি বৈধ পাসপোর্ট থাকতে হবে।
- বয়স সাধারণত ২১ বছর বা তার বেশি হতে হবে।
- আর্থিকভাবে সক্ষম হতে হবে অর্থাৎ আবেদনকারী শক্ত আর্থিক অবস্থায় থাকতে হবে।
- যদি সৌদিতে ইতিমধ্যে বসবাস করে থাকেন, তবে সেই অবস্থায় আপনার বর্তমান ইকামা বৈধ থাকতে হবে।
- অপরাধমূলক রেকর্ড থাকা যাবে না।
- স্বাস্থ্যসনদ থাকতে হবে, সংক্রমণবিহীন রোগ-মামলা না থাকলে আবেদন সম্ভব।
- আবেদনপ্রক্রিয়া ও নির্ধারিত ফি জমা দিতে হবে।
- আর ২০২৪-২৫ সালে নতুনভাবে কিছু নিচু ফি ক্যাটাগরি চালু করা হয়েছে যেমন ‘স্পেশাল ট্যালেন্ট’, ‘উদ্যোক্তা’, ‘রিয়েল এস্টেট মালিক’ ইত্যাদি যেগুলোর ফি কম হতে পারে।
মূল সুবিধাসমূহ
প্রিমিয়াম ইকামা ধারণকারীদের জন্য বেশকিছু বিশেষ সুবিধা রয়েছে- সাধারণ ইকামা-ভিত্তিক কর্মীদের থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতা ও লাইফস্টাইল সুবিধা। উল্লেখযোগ্যগুলো হল কোনো নিয়োগকর্তার (স্যনসর) বরাবর আটকে থাকতে হয় না; অর্থাৎ নিজেই কাজ পরিবর্তন, ব্যবসা শুরু ইত্যাদি করতে পারবেন। পরিবারসহ সৌদি আরবে বসবাসের অনুমতি; স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে। বাড়ি, কমার্শিয়াল বা শিল্প রিয়েল এস্টেট একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে মালিকানা সুযোগ (মক্কা-মদিনা ও সীমান্ত অঞ্চলে কিছু বিধিনিষেধ থাকতে পারে)। দেশ থেকে বের হওয়া ও ফিরে আসার ক্ষেত্রে বেশি স্বাধীনতা; নির্ধারিত ‘প্রবেশ/বের হওয়া’ অনুমোদনের প্রয়োজন কম বা নেই। বিদেশি শ্রমভর্তি ফি, নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার নিয়ন্ত্রণ বা ‘নিতাকাত’ (সৌদি কোটা) প্রভাব কম।
ফি ও মেয়াদ
- প্রথম দিকে ঘোষণা করা হয়েছিল- স্থায়ী প্রিমিয়াম ইকামার জন্য সৌদি টাকা ৮০০,০০০ (২.৫২ কোটি টাকা) এবং বার্ষিক নবায়নযোগ্য এক বছরের জন্য প্রায় প্রতি বছর আনুমানিক ৩১.৫ লক্ষ টাকা)।
- তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন ‘সস-ক্যাটাগরি’ চালু হয়েছে যেখানে ফি অনেক কম করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ ক্যাটাগরিতে ঝজ ৪,০০০ ফি দিয়ে আবেদন করা যেতে পারে।
- মেয়াদ নিয়ে: এক বছরের জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদি এবং স্থায়ী ধরনের রয়েছে।
বাতিল বা প্রত্যাহারের কারণ
কিছু ক্ষেত্রে এই অনুমোদন বাতিল বা প্রত্যাহার হতে পারে নিচের কারণে-
- আবেদনপত্রে ভুল তথ্য দেওয়া বা প্রতারণামূলক তথ্য।
- অপরাধে দ-প্রাপ্ত হওয়া (উদাহরণস্বরূপ ৬০ দিন বা তার বেশি কারাদ- অথবা ঝজ ১০০,০০০ বা তার বেশি জরিমানা)।
- পদার্থ বিক্রয়, বিনিয়োগ শর্ত না পালনে বা উদ্দেশ্য বিঘেœ।
- ফিরে বসবাস বা নিয়মানুসারে কাজ না করা বা বৈধতা হারানো।

