বাংলাদেশের গ্রাম-বাংলার যুব সমাজের হৃদয়ে প্রবাস শব্দটি এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি করে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা, ফসলের মাঠ, কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডায় যখন প্রবাসী ভাই বা চাচা এসে নতুন মোবাইল, দামি পোশাক কিংবা বিদেশি সুগন্ধি নিয়ে আসে, তখন অনেক তরুণের চোখে জ্বলে ওঠে স্বপ্নের আগুন। তারা ভাবে বিদেশ মানেই টাকার পাহাড়, আরামদায়ক জীবন, সাফল্য ও সম্মান। কিন্তু এই স্বপ্নের পেছনে লুকিয়ে থাকে এমন এক কঠিন বাস্তবতা, যা অনেকেই কল্পনাও করে না। প্রবাসের জীবন যতটা জৌলুসে ভরা মনে হয়, বাস্তবে তা অনেক বেশি ত্যাগ, শ্রম, একাকিত্ব আর সংগ্রামের গল্প। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবাসী আসে গ্রামের সাধারণ পরিবার থেকে। তাদের শিক্ষা, ভাষা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা সীমিত। তারা ভাবে, বিদেশে গেলেই কাজ পাওয়া সহজ হবে, টাকা জমে যাবে, পরিবারে সুখ আসবে।
এই চিন্তা থেকেই অনেকে দালালের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বা জমি বিক্রি করে প্রবাসে পাড়ি জমায়। কিন্তু দালালের প্রতারণা, ভিসার জটিলতা কিংবা ভুল তথ্যের কারণে অনেকেই বিদেশে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ কাজ না পেয়ে দিন পার করে রাস্তায়, কেউ আবার অবৈধভাবে কাজ করে পুলিশের ভয়ে রাত কাটায় অস্থিরতায়। এই কঠিন বাস্তবতা স্বপ্নকে খুব দ্রুত ভেঙে চুরমার করে দেয়।
প্রবাস জীবনের অন্যতম ভয়াবহ দিক হলো একাকিত্ব ও মানসিক চাপ। দেশের মাটিতে যে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী সবসময় পাশে ছিল, বিদেশে এসে সে সম্পর্কগুলো কেবল ফোনের পর্দায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রমের পর ছোট্ট একটি ঘরে ফিরে একা ঘুমাতে হয়। প্রিয়জনের হাসি, সন্তানের মুখ দেখা, মায়ের রান্নার গন্ধসহ সবকিছুই হয়ে ওঠে এক অমূল্য স্মৃতি। এই মানসিক চাপের কারণে অনেক প্রবাসী হতাশায় ভোগে, কেউ কেউ আবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তবুও তারা পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে নিজের কষ্ট লুকিয়ে কাজ করে যায়।
প্রবাসে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো কঠোর শ্রমের বিনিময়ে টিকে থাকা। যেসব তরুণ বিদেশে যাওয়ার আগে ভাবে একটু কষ্ট করলেই অনেক টাকা আয় হবে, তারা গিয়ে বুঝতে পারে এখানে প্রতিটি টাকা ঘামের বিনিময়ে আসে। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, রেস্তোরাঁ সহকারী কিংবা কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়। আবহাওয়া, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছুই আলাদা। অনেক সময় খাবার বা বিশ্রাম ঠিক মতো না পেয়ে শরীর ভেঙে পড়ে। কিন্তু পরিবারকে কিছু না জানিয়ে তারা কেবল টাকা পাঠায়, যেন মা-বাবা সুখে থাকে। এই আত্মত্যাগই আসলে প্রবাসীর জীবনের বাস্তব রূপ। তবে প্রবাস জীবন কেবল কষ্টের নয় এটি এক অমূল্য শিক্ষার ক্ষেত্র। যে তরুণ বিদেশে গিয়ে ধৈর্য, পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জীবন গড়ে, সে একসময় সফল হয়। প্রবাসে থেকেই অনেকেই শিখে নেয় সময় ব্যবস্থাপনা, দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও আত্মনির্ভরতা।
অনেকেই স্থানীয় ভাষা শিখে নিজেকে উন্নত কাজের উপযুক্ত করে তোলে। কেউ কেউ আবার ব্যবসা শুরু করে, দেশে ফিরে উদ্যোক্তা হয়। এরা বুঝে যায় প্রবাস মানে শুধু টাকা নয়, নিজের দক্ষতা ও মানসিক শক্তিকে গড়ে তোলার সুযোগও বটে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সবাই এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে না। অনেকে প্রথমেই ভুল পথে পা বাড়ায়। যেমন: ভুল দালালের ওপর নির্ভর করা, অবৈধভাবে কাজ নেওয়া, বা বিদেশের আইন না মানা। এই ভুলগুলো অনেক সময় জীবনকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ফেলে দেয়। কেউ চাকরি হারায়, কেউ দেশে ফিরে আসে ঋণের বোঝা নিয়ে। তাই প্রবাসে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় জানা ও শেখা অত্যন্ত জরুরি।
প্রথমত, সঠিক তথ্য ও বৈধ উপায়ে বিদেশ যাত্রা করা উচিত। সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গেলে প্রতারণার ঝুঁকি কমে। দ্বিতীয়ত, ভাষা ও কাজের দক্ষতা অর্জন করা দরকার। ইংরেজি, আরবি বা স্থানীয় ভাষায় কিছুটা দক্ষতা থাকলে কাজ পাওয়া সহজ হয়। তৃতীয়ত, আর্থিক পরিকল্পনা ও সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। প্রবাসে অর্জিত অর্থ অপচয় না করে সঞ্চয় ও বিনিয়োগে মনোযোগী হলে ভবিষ্যৎ নিরাপদ হয়। এ ছাড়া, প্রবাসীরা যদি নিজেদের মধ্যে সমাজ ও সহযোগিতার বন্ধন গড়ে তোলে, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়। অনেক দেশে বাংলাদেশি কমিউনিটি আছে, যেখানে নতুন আগতদের সাহায্য করা হয়, চাকরি খুঁজে দেওয়া হয়, এবং মানসিক সমর্থন দেওয়া হয়। এসব কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত থাকলে প্রবাস জীবন তুলনামূলক সহজ হয়।
সবশেষে, প্রবাস জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো নিজের সম্মান ও দেশের মর্যাদা রক্ষা করা। একজন প্রবাসীর আচরণ, কাজের মান এবং সততা বিদেশে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে। যদি প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তবে প্রবাসী সমাজ শুধু নিজের জীবন নয়, দেশের অর্থনীতিতেও বিশাল অবদান রাখতে পারে। প্রবাসী স্বপ্নের শুরু হয় অনেক আশায়, কিন্তু বাস্তবতা শেখায় ত্যাগ ও সংগ্রামের অর্থ। কেউ এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে জীবন বদলে দেয়, কেউ আবার তাতে
হারিয়ে যায়। যারা শেখে, তারা ফিরে আসে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। নিজের পরিবার, সমাজ, এমনকি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সংকল্প নিয়ে। তাই বলা যায়, প্রবাস হলো
জীবনের এক কঠিন বিদ্যালয়, যেখানে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যে টিকে থাকতে পারে, সেই প্রকৃত অর্থে সফল প্রবাসী।
লেখক: মালয়েশিয়া প্রবাসী

