শীত মানে কনসার্টের ভরা মৌসুম। প্রতিবছরই শীতের আগমনী বার্তায় একটু একটু উন্মাদনা ছড়াতে দেখা যায় কনসার্টগুলোয়। বিশেষ করে ওপেন এয়ার কনসার্টে বাড়তে থাকে গানপ্রেমীদের উচ্ছ্বাস-উল্লাস। কিন্তু পট পরিবর্তনের পর গানপিপাসুদের সেই উন্মাদনায় ভাটা পড়েছে। গত কয়েক মাস ধরেই একের পর এক কনসার্ট স্থগিত-বাতিল, আয়োজকরা বিপাকে আর হতাশায় তরুণরা। স্থগিত-বাতিলে স্তব্ধ শীতের শহর! তবে কি থেমে যাচ্ছে কনসার্ট সিজন?
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে অন্তত সাতটি বড় কনসার্ট ও দুটি শোরুম উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্থগিত হয়েছে। রকস্টার জেমস, সোনু নিগম, আলী আজমতসহ আন্তর্জাতিক মানের শিল্পীদের অনুষ্ঠান এবং ব্যান্ডের শো বাতিল হওয়ায় শিল্পী, আয়োজক ও সংগীতপ্রেমীরা সবাই হতাশার মুখোমুখি। বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অস্থিতিশীলতার ছাপ ফেলেছে।
গত মৌসুমে ঢাকায় বেশ কয়েকটি কনসার্ট হলেও এবারের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন; ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির’ কথা বলে অনুমতিই দিতে চাইছে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যে কারণে একের পর এক কনসার্ট স্থগিত হচ্ছে। বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিকল্পনার পর এসব আয়োজন বাতিল হওয়ায় একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আয়োজকরা, অন্যদিকে টিকেটের টাকা ফেরত না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন দর্শকরাও।
জানা গেছে, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আপাতত কোনো কনসার্টের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। প্রায় দেড় মাস ধরে অনুমোদন দেওয়া বন্ধ রয়েছে।
সবশেষ গত শুক্রবার অনুষ্ঠেয় পাকিস্তানি ব্যান্ড ‘কাভিশ’র ‘ওয়েভ ফেস্ট: ফিল দ্য উইন্টার’ শিরোনামের কনসার্ট প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও স্থগিত হয়েছে। শেষ মুহূর্তে অনুমতি না মেলার কারণে স্থগিত হয় এই কনসার্ট। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে মেহেরপুরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল রকস্টার জেমসের একক কনসার্ট। স্থানীয় প্রশাসন কনসার্টের অনুমতি না দেওয়ায় আয়োজকরা শেষ মুহূর্তে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করতে বাধ্য হন। রাজনৈতিক চাপ এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগকে বাতিলের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
গত ১৪ নভেম্বর ঢাকায় ইউনাইটেড কনভেনশন সেন্টারে আয়োজনের কথা ছিল লিজেন্ডস লাইভ ইন ঢাকা কনসার্ট, যেখানে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল আলী আজমত ও জেমসের। অনুষ্ঠানের দিন সকালে আয়োজকরা জানায়, ভেন্যু ও প্রশাসনিক অনুমোদন সংক্রান্ত অসুবিধার কারণে কনসার্ট স্থগিত হচ্ছে। পরে রাতেই চূড়ান্তভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়। আয়োজক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, টিকিটধারীদের জন্য পরবর্তী নোটিশ দেওয়া হবে। তবে কনসার্ট স্থগিতের তিন সপ্তাহ পেরোলেও এখনো রিফান্ডের বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
গত নভেম্বরে আরও দুটি কনসার্ট স্থগিত হয়। ২৮ নভেম্বর রাজধানীর ৩০০ ফুটের স্বদেশ অ্যারেনায় ‘সাউন্ড অব সোল’ শীর্ষক কনসার্ট করার কথা ছিল পাকিস্তানি ব্যান্ড ‘জাল’র। সঙ্গে পারফর্ম করার কথা ছিল দেশের ব্যান্ড ওয়ারফেজ ও লেভেল ফাইভের। অনুষ্ঠানের পাঁচ দিন আগে আয়োজক প্রতিষ্ঠান ‘স্টেইজ কো’ জানায়, সরকার কনসার্টের অনুমতি দিচ্ছে না; টিকিটের টাকা রিফান্ড করা হবে।
ওয়েভ ফেস্ট : ফিল দ্য উইন্টার কনসার্টটি গত ৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পাকিস্তানি ব্যান্ড কাভিশসহ স্থানীয় ব্যান্ড শিরোনামহীন ও মেঘদলও পারফর্ম করার কথা ছিল। তবে ভেন্যুর অনুমতি না পাওয়ায় এবং নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে আয়োজকরা শেষ মুহূর্তে কনসার্ট বাতিলের ঘোষণা দেন। কাভিশ ব্যান্ড কোনো পারফর্মেন্স না করে ঢাকা ছেড়ে যায়।
কনসার্ট স্থগিত নিয়ে শোরগোলের মধ্যে ভারতের সংগীতশিল্পী অনুভ জৈনের সংগীত অনুষ্ঠানও স্থগিত হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর মাদানি অ্যাভিনিউয়ের (১০০ ফুট) কোর্টসাইডে এ কনসার্ট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে আয়োজক কোম্পানি হাইপনেশন গত ২৫ নভেম্বর এটি স্থগিতের ঘোষণা দেয়।
গত ১১ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল মুস্তাফা জাহিদের ‘মেলোডি আনলিশড’ শিরোনামের কনসার্ট। আয়োজকরা কেবল নিরাপত্তাজনিত কারণে অনুষ্ঠান বাতিলের ঘোষণা দেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা আগারগাঁওয়ের পুরোনো বাণিজ্যমেলার মাঠে ‘রিবিল্ডিং দ্যা নেশন’ শিরোনামে একটি কনসার্ট আয়োজনের কথা ছিল, যেখানে অংশ নেওয়ার কথা ছিল জেমস, চিরকুট ও আর্টসেল-এর। তবে একদিন আগে আয়োজকরা নিরাপত্তাজনিত কারণে কনসার্ট স্থগিত ঘোষণা করেন।
শুধু গানের কনসার্টই নয়, বিভিন্ন ইভেন্ট ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও স্থগিত করতে হয়েছে। বছরের শুরুতে অর্থাৎ গত ২৫ জানুয়ারি একটি শোরুম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল চিত্রনায়িকা পরীমণির। তবে স্থানীয়দের বাধার মুখে মাঝ রাস্তা থেকে ঢাকা ফিরে আসেন এই অভিনেত্রী।
অন্যদিকে, অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীকে চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজারে একটা লাইফস্টাইল শোরুম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রাণ কিছু গোষ্ঠীর প্রতিবাদ, হুমকি এবং নিরাপত্তা ঝুকির কারণে শোরুম কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন স্থগিত করেন।
এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় গত ৫ আগস্ট আয়োজনের কথা ছিল ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিজয়’ উদযাপনের অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক কনসার্ট। এতে অংশগ্রহণের কথা ছিল দিলশাদ নাহার কনা, সজল, অনিকা কবির শখ, ফ্লাই ডান্সারস গ্রুপসহ আরও কয়েকজনের। স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের আপত্তি এবং সামাজিক চাপের কারণে আয়োজকরা অনুষ্ঠান স্থগিত করতে বাধ্য হন।
এরই মধ্যে একাধিকবার সংগীতপিয়াসীদের মন ভেঙে দিয়েছে আয়োজকরা। অনেকে এখনো ফেরত পাননি টিকিটের টাকা। এর মধ্যেই আগামী ১৩ ডিসেম্বর মেইন স্টেজ আয়োজিত এক কনসার্টে গান শোনাতে আসার কথা রয়েছে পাকিস্তানি গায়ক আতিফ আসলামের।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে কনসার্ট হবে কি? প্রশ্ন শুনে মেইন স্টেজের স্বত্বাধিকারী নিশা সালাম বলেন, আমাদের এই কনসার্টের একটা অংশ যাবে গণআন্দোলনে হতাহতদের পরিবারকে সহায়তায়। এটা যেহেতু চ্যারিটি কনসার্ট, অনুমতি না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা অনুমতি নেওয়ার সব প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করেছি, এখনো আশাবাদী, সুন্দর করে কনসার্টটি আমরা করতে পারব।
সম্প্রতি গাজীপুরের শিমুলতলীতে ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় গান গাইতে গিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন শ্রোতাপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফাতেমা তুয যাহরা ঐশী। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কনসার্টে তর্কাতর্কি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরপর খবর রটে, এ সময় অববরুদ্ধ হয়ে পড়েন ঐশী ও তার গানের দল। তবে খবরটি সঠিক নয় জানিয়ে ঐশী বলেছেন, ‘কনসার্টটি একদম সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে শেষ হয়। তার দল নিরাপদেই অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে। তাদের বেরিয়ে যাওয়ার পরই মেলায় ভাঙচুর ও মারামারির ঘটনাটি ঘটে।’
ওপেন কনসার্ট বাতিল হলেও থেমে নেই প্রাইভেট কনসার্ট। যেদিন আলী আজমতের কনসার্ট বাতিল করা হয়, তার ঠিক আগের দিনই ঢাকার বসুন্ধরা আইসিসিবিতে আলী আজমতের একটি প্রাইভেট কনসার্ট হয়েছে। জালের কনসার্ট যেদিন স্থগিত হলো, তারাও কিন্তু দেশে এসে গুলশান ক্লাবে একটি প্রাইভেট কনসার্ট করেছে। এমনকি পাকিস্তানি গায়ক ফারহান সাঈদ চট্টগ্রামের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানেও গান গেয়ে গেছেন। এ ছাড়া নিয়মিত ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে প্রাইভেট কনসার্ট হচ্ছে।
স্থগিত হওয়া কনসার্টে বিদেশি শিল্পীর পাশাপাশি দেশের শিল্পীদেরও পারফর্ম করার কথা ছিল। একের পর এক কনসার্ট স্থগিত ও ভেন্যু পরিবর্তনের ঘটনায় প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পী দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশে সবকিছুই হচ্ছে কিন্তু কনসার্টের ক্ষেত্রে নানা অজুহাত। কেন এসব হচ্ছে? ক্রিকেট হচ্ছে, ফুটবল হচ্ছে, ওয়াজ-মাহফিল হচ্ছে, সব ধরনের জনসমাগম হচ্ছে; তাহলে কনসার্টেই শুধু সমস্যা কেন? সরকার থেকে কেন সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে না? কনসার্টেই শুধু দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও অস্থিরতা প্রসঙ্গ আসে। কনসার্ট স্থগিতের ঘটনায় শিল্পীদের সম্মানহানি ও দর্শকের আস্থা হারানোর কথাও তুলে ধরেন এই শিল্পী।
প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, সারা বছর আমরা এই শীতের অপেক্ষায় থাকি। কারণ, শীত মৌসুমে স্টেজের দারুণ সময়। আমরা যারা স্টেজে নিয়মিত গান করছি তাদের জন্য শীত ঈদের চেয়ে আনন্দ নিয়ে আসে। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে ঠিকমতো কনসার্ট আয়োজন করা যাচ্ছে না। আয়োজন হলেও আসে নানা বাধা। এক ধরনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের স্টেজে উঠতে হয়। আমরা যারা স্টেজের আয়ে নির্ভরশীল তাদের কি অবস্থা হচ্ছে একটিবার কেউ কি ভেবেছে? দিনশেষে আমাদের কথা কেউ ভাবে না।
মিউজিক মানুষকে মননশীল ও সৃজনশীল করে তুলে। কনসার্টে গেলে সেই চিন্তা শক্তি বেড়ে যায় বলে জানান এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা। লাইট, সাউন্ড ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট- একটি কনসার্টের সঙ্গে জড়িত থাকে শত শত মানুষ। শিল্পীদের দাবি, কনসার্ট বন্ধ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো সংগীতাঙ্গন।
মানসিক স্বাস্থ্য গবেষক রুবিনা হক বলেন, যখন বিনোদনের মাধ্যম কমে যায় তখন হতাশায় ভুগে তরুণরা। কনসার্টে গেলে একে অন্যের সঙ্গে দেখা হয়, আনন্দে মেতে উঠে সবাই। এক ধরনের উন্মাদনা তৈরি হয়। যখন সেই বিনোদন কমে যায় তখন তরুণ-তরুণীরা একাকিত্ব অনুভব করে। যে কারণে চাপ বেড়ে যায়। মিউজিক বাঁচিয়ে রাখতে এবং তরুণদের বাঁচিয়ে রাখতে কনসার্ট বন্ধ না করে চালিয়ে রাখা দরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঝামেলা এড়াতে আপাতত কনসার্টের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
শোনা যাচ্ছে, আগামী ১৩ ডিসেম্বরের মেইন স্টেইজের কনসার্টটিও মৌখিকভাবে ‘না’ করে দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। নির্বাচন সামনে রেখে তার কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। যে কারণে আতিক আসলামের কনসার্ট ঘিরেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। তবে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বলছে, কনসার্টের সব অনুমতি মিলেছে, এর সঙ্গে দর্শকদের জন্য থাকবে বিআরটিসির ফ্রি শাটল সার্ভিস।
কনসার্ট যেমন আনন্দের, টাকায় টিকিট কিনে কনসার্ট দেখতে না পাওয়াটাও তেমনটাই বিষাদের। আয়োজকরা আশ্বস্ত করলেও শেষ পর্যন্ত শিল্পীদের আগামী কনসার্টগুলো নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে কিনা, তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।

