ঢাকা রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

কাদায় স্বপ্ন বুনছে উপকূলের কৃষক

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৫, ০৬:১৪ এএম

চলছে বর্ষার ভরা মৌসুম। আকাশে মেঘ, মাঠে পানি ও চারপাশে সবুজের ছোঁয়া। এ সময়টাতেই যেন প্রাণ ফিরে পায় উপকূলের কৃষকরা। যেদিকে চোখ যায় শুধু কাদামাখা জমি আর কৃষকের কর্মচাঞ্চল্য। রোপা আমন ধান রোপণের এ মৌসুম উপকূলের মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনছেন ফসলের মাঠে।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নানা বয়সি কৃষকরা মাঠে নেমে পড়েন। কাদা-পানির ভেতর একে একে সাজানো হচ্ছে ধানের সবুজ চারা। কাদায় ডুবে যাচ্ছে পা, শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছে কাদা। তবুও চোখে-মুখে নেই ক্লান্তি। বরং সবার চোখে-মুখে ফুটে উঠছে আনন্দ আর আশা। যেন কাদা নয়, জমির বুকে বুনছে তারা আগামীর স্বপ্ন।

সরেজমিন দেখা গেছে, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠে আমন ধান রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। কোথাও ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ হচ্ছে। কোথাও চলছে আগাছা পরিষ্কার, আবার কোথাও দলবদ্ধভাবে চারা রোপণ চলছে। দেশি ধানের পরিবর্তে এখন কৃষকেরা বেশি চাষ করছেন ব্রি ধান-৪৯, ব্রি ধান-৫১, ব্রি ধান-৫২ এবং দেশি সাদা মোটা, জিরা বাদামসহ হাইব্রিড জাত। বৃষ্টির পানিতে জমি তৈরির পর কৃষক আমন ধান রোপণ করছেন। পানি সেচ ছাড়াই বৃষ্টির পানিতে রোপণকৃত চারাও ভালো হয়। এতে তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। বিগত বছরের চেয়ে এ বছর আমন চাষে কৃষকরা ঝুঁকছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারণে সময়মতো ধান রোপণ করতে পারছেন তারা।

লতাচাপলী ইউনিয়নের আছালতপাড়া গ্রামের কৃষক কামাল হোসেন বলেছেন, ‘এ বছর বর্ষার শুরুতে বৃষ্টি ছিল। তাই বীজতলা তৈরি ও হালচাষে বিলম্ব হয়নি। তবে গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি না থাকায় কোথাও কোথাও চাষের জমি শুকিয়ে গেছে।’

কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ধান রোপণ মানে শুধু ফসল নয়, পরিবারের ভবিষ্যৎ। যদি ফসল ভালো হয়, তবে সারা বছর চাল কিনতে হয় না। বছর শেষে লাভ হয়।

উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় ৩০ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হবে। এরই মধ্যে কৃষকেরা জমি তৈরি, বীজতলা থেকে চারা উত্তোলন ও রোপণের কাজ শুরু করেছেন পুরোদমে। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৫০০ হেক্টরে ইতিমধ্যে চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই শতভাগ রোপণ সম্পন্ন হবে। ভালো আবহাওয়া আর ঘূর্ণিঝড়মুক্ত মৌসুম হলে উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে বাড়বে বলেও আশা করা হচ্ছে। তবে কৃষকের পথ সহজ নয়। জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি কিংবা লবণাক্ত পানির প্রবাহ ফসলের সবচেয়ে বড় শত্রু। বহুবার দেখা গেছে, ভালোভাবে রোপণ শেষে কয়েক ঘণ্টার ঘূর্ণিঝড়ে তলিয়ে যায় কৃষকের সব আশা। তবু তারা হাল ছাড়েন না। আবার চারা তুলে, আবার রোপণ করে নতুন করে শুরু করেন।

কৃষক খোকন কাজী হাসিমাখা মুখে বললেন, ‘কাদা-মাটি, ভেজা শরীর, ব্যথা সব ভুলে যাই, যখন দেখি সবুজ চারা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।’

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নাহিদ হাসান বলেন, বর্ষা মৌসুমে উপজেলার উঁচু এলাকার জমিগুলো অলস পড়ে থাকে। তাই কৃষকদের আমন ধান রোপণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি পাওয়ায় আমন চাষে আগ্রহী হচ্ছে কৃষকরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর এই উপজেলায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হবে। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন কৃষকের কাছে গিয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ বছর উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আমন রোপণ হবে।

ধানের চারা যেমন কাদামাটি থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায়, তেমনি উপকূলের কৃষকরাও প্রতিকূলতার মাঝেই খুঁজে নেন জীবনের স্বপ্ন। আমন ধান রোপণের এ মৌসুম শুধু কৃষিকাজ নয়, বরং উপকূলের সংগ্রামী মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক।