ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

নিয়ন্ত্রণহীন ইজিবাইকে বাড়ছে দুর্ঘটনা

হাসানুর রহমান তানজির, খুলনা
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫, ০১:৩১ এএম

*** সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনুমোদনের চেয়ে ৪ গুণ বেশি
*** প্রতিদিনই সড়কে নামছে নতুন নতুন ইজিবাইক
*** অনভিজ্ঞ চালকদের বেপরোয়া চলাচল ও যত্রতত্র পার্কিংয়ে ভোগান্তিতে পথচারীরা
*** কার্যকরী পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের, বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদ্যুৎ ঘাটতি

খুলনায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক বা অটো। প্রতিদিনই নতুন নতুন ইজিবাইক নামছে সড়কে। শহর অলিগলি থেকে শুরু করে মহাসড়ক পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এগুলো। অনভিজ্ঞ চালকদের বেপরোয়া চলাচল ও যত্রতত্র পার্কিংয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন পথচারীরা। অনুমোদনের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেশি ইজিবাইক রাস্তায় নামায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। শুধু আমদানিই নয়, স্থানীয়ভাবে অবৈধ কারখানাও গড়ে উঠেছে এই বাহন তৈরির জন্য। ফলে সংখ্যার পাশাপাশি বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদাও। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ঘটলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিল্পনগরী খুলনায় পাটকল বন্ধ হয়ে পড়ায় হাজারো শ্রমিক জীবিকার সন্ধানে বেছে নিয়েছেন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা চালানোর পেশা। সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন, শহরে এই যানবাহনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটি। ফলে প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে অসহনীয় যানজট, পাশাপাশি দুর্ঘটনার শঙ্কাও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায়শই প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে, অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করছেন।

আরও জানা গেছে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর লবণচরা থানার দক্ষিণ মোহাম্মদ নগর স্লুইসগেট এলাকায় ইজিবাইকের ধাক্কায় মুনতাজিন (৫) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট সকালে ডুমুরিয়া উপজেলার খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের জিলেরডাঙ্গা এলাকায় ইজিবাইক ও পিকআপের সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন নিহত হন। এতে মুহূর্তেই নিভে যায় চারটি পরিবারের আলোক প্রদীপ।

এ সময় আহত হয় আরও চারজন। এর আগে গত ৯ জুন সকাল ৬টার দিকে খানজাহান আলী সেতুর (রূপসা সেতু) পশ্চিম প্রান্তে দারোগার লিজ নামক স্থানে ট্রাকের ধাক্কায় ইজিবাইকের চালকসহ দুজন নিহত হন। চলতি বছরে ইজিবাইকের এমন বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে। হতাহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। গেল ৮ মাসে শুধু এই মহাসড়কে ১৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইজিবাইক ছাড়াও অন্যান্য বাহনে দুর্ঘটনায় ঝরছে মানুষের প্রাণ।

খুলনার খর্নিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গেল ৮ মাসে খুলনা-ডুমুরিয়া-পাইকগাছা-সাতক্ষীরা সড়কে ১৬টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ১৭ জন আহত হন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিসংখ্যান মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খুলনা জেলা ও মহানগরসহ বিভাগের ১০ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৬৮৯টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬৩৩ জন। আহত হয়েছেন ৬৫১ জন। এরমধ্যে খুলনা জেলায় সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৬টি। এতে নিহত হন ৪০ জন এবং আহত হন ২৯ জন।

ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, খুলনায় ৭২টি ইজিবাইকের চার্জিং পয়েন্ট রয়েছে। তাদের জন্য দৈনিক ৮৯১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ থাকে।

তবে স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, খুলনায় কয়েকশ’ ইজিবাইকের চার্জিং পয়েন্ট রয়েছে। প্রতিটি চার্জিং পয়েন্টে ৫-২০টি ইজিবাইক চার্জ দেওয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে এই সংখ্যা আরও বেশি। ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে দাঁড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইজিবাইক চার্জিং পয়েন্টের মালিক জানান, একটি ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জে দৈনিক ১০-১২ ইউনিট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। প্রতি ইউনিটের জন্য ১৬ টাকা করে নেন তারা।

খুলনা মহানগরের সোনাডাঙ্গা থেকে গল্লামারী মোড় পর্যন্ত অসংখ্য ইজিবাইকের শো-রুম রয়েছে। চীন থেকে যন্ত্রপাতিসহ মালামাল আমাদানি করে তারা এখানেই ইজিবাইক ফিটিংস করে বিক্রি করেন। শুধু আমদানি করা ইজিবাইকই নয়, মহানগরের শেখপাড়াসহ কয়েকটি স্থানে অবৈধভাবে তৈরি হচ্ছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা।

খুলনা সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স অফিসার শেখ মো. দেলওয়ার হোসেন বলেন, সর্বশেষ ২০১৯ সালে নগরীতে ৭ হাজার ৮৯৮টি যাত্রীবাহী এবং ২০২১ সালে ২ হাজার ৯৬টি পণ্যবাহী ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০০৫-২০০৬ সালে ১৭ হাজার রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে রিকশার পরিমাণ কম রয়েছে। নগরীতে এখন ২৫-৩০ হাজার ইজিবাইক চলাচল করছে বলে আমরা ধারণা করছি।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) খুলনার সাধারণ সম্পাদক মো. মাহাবুবুর রহমান মুন্না বলেন, সিটি করপোরেশন ৭-৮ হাজার লাইসেন্স দিয়েছে, কিন্তু ২৫-৩০ হাজার ইজিবাইক নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে, যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। নগরীতে ইজিবাইক চলাচল নিয়ন্ত্রণে কেসিসি এবং কেএমপির ট্রাফিক বিভাগ সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বারবার বলা সত্ত্বেও তারা কাজের কাজ করছে না। ইজিবাইক এখন নগরবাসীর কাছে বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, ইজিবাইক শুধু খুলনা নয়, সারা দেশে চলাচল করছে। বিআরটিএ আছে, তাদের পলিসি নিতে হবে কী পরিমাণ ইজিবাইক রাস্তায় চলাচলের অনুমোদন দেবে। একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ইজিবাইক আমদানি, তৈরি ও বিপণন হচ্ছে। ইজিবাইক চললে তার যন্ত্রাংশ লাগবে। কতটুকু পরিমাণ যন্ত্রাংশ আনা যাবে, এর বাইরে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে দেবে না। এই পলিসির জায়গায় যদি সরকার চিন্তা করতে পারে তাহলে ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।