ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গ্যাস সংকটে বন্ধ সার কারখানা

মো. বাবুল মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫, ০১:৪৭ এএম
  • প্রতি মাসে ১৩৫ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে
  • গ্যাস সংকটে কমেছে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা
  • নষ্ট হচ্ছে শতকোটি টাকার যন্ত্রপাতি
  • চাকরি-বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তায় কর্মকর্তা-কর্মচারী

কৃষি ক্ষেত্রে উদ্ভিদের বৃদ্ধি, ফসলের ফলন ও আকার বৃদ্ধিতে নাইট্রোজেনের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ নাইট্রোজেন আসে ইউরিয়া সারের মাধ্যমে। দেশের কৃষি খাতের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ইউরিয়া সার উৎপাদন করে আশুগঞ্জ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড। যেটি গ্যাস সংকটে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় অচল অবস্থায় পড়ে আছে। এতে একদিকে যেমন ইউরিয়া সারের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে অন্যদিকে সারা বছর ফ্যাক্টরি বন্ধ থেকে ধ্বংসের মুখে পড়ছে শতকোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশুগঞ্জ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরিতে প্রতিদিন ৪ কোটি টাকার ইউরিয়া সার উৎপাদন হয়। তবে গ্যাস সংকটে কারখানা বন্ধ থাকায় প্রতি মাসে ১৩৫ কোটি টাকার সার উৎপাদনে ব্যাহত হওয়ায় কোটি কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়েছে কারখানাটি। আবার কৃষকদের অতি প্রয়োজনীয় সার উৎপাদন বন্ধ থাকায় বিদেশ থেকে অতিরিক্ত ইউরিয়া আমদানি করছে সরকার। এতে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে, তেমনি কৃষি খাতেও বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার মেঘনার পূর্বপাড়ে ১৯৮৩ সালে ৫৩৬ একর জমির ওপর স্থাপিত হয় আশুগঞ্জ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি। বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার পর থেকেই কারখানাটি দ্রুতই লাভজনক খাতে পরিণত হয়। প্রতিবছর গড়ে সোয়া ৪ লাখ টন ইউরিয়া সার উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে গ্যাস সরবরাহে ধারাবাহিক সংকট শুরু হলে উৎপাদনে ভাটা পড়তে থাকে। একসময় যে কারখানা দেশের সারের চাহিদার বড় অংশ জোগান দিত। অথচ একসময়ের লাভজনক কারখানা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

কারখানার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বনাম বাস্তবতা অনুসন্ধানে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার টন, উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৫৫ টন। ২০২২ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার টন, উৎপাদন হয়েছে ৯৬ হাজার ৪৬ টন। ২০২৩ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ টন, উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৪২০ টন। ২০২৪ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ টন, উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৪৮ হাজার ৪৫৩ টন। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাসের সংকট এতটাই চরম আকার ধারণ করে যে পুরো বছর কারখানা সচল ছিল মাত্র ৪১ দিন।

এদিকে কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন চাকরি ও বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তারা জানান, বছরের পর বছর উৎপাদন বন্ধ থাকায় কারখানার যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ছে। অচল অবস্থায় থাকার কারণে যন্ত্রাংশগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা মেরামত করতে আবার বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গ্যাস নেই বলেই হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অচল অবস্থায় পড়ে আছে। মার্চ মাস থেকে সার কারখানাটি বন্ধ রয়েছে। অথচ আমরা বসে বসে শুধু ক্ষয়ক্ষতি দেখছি।

আশুগঞ্জ সার কারখানা শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আবু কাউসার বলেন, ‘এখনো আমদানিনির্ভরতা রয়ে গেছে। দেশের সার কারখানাগুলো বন্ধ রেখে আমদানির প্রতি তোড়জোড় চলছে। দেশের সার কারখানাগুলো বন্ধ রাখা মোটেও উচিত হচ্ছে না। এটা জনগণের সম্পদ। একটা নতুন সার কারখানা করতে গেলে ২০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। নতুন কিছু যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করে আমরা যদি এ সার কারখানাগুলো চালু করি তাহলে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। আমদানি নির্ভরতা কমাবে।’

কারখানাটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) তাজুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, আশুগঞ্জ সার কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে প্রতিদিন ৬০০ পিএসআই চাপে প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হয়। এরই মধ্যে প্রতিটি সার কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে কমিটি হয়েছে। অর্থ-মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের প্রশ্ন করা হয়েছে। আমরা বলেছি, ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে গ্যাস দিলে আমরা প্রোডাকশনে যেতে পারব।’

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘গ্যাস সরবরাহের সংকটের কারণে বর্তমানে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে। আমরা নিয়মিত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে দ্রুতই উৎপাদন কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা সম্ভব হবে।’