এশিয়ার মহীয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। লাকসামের ডাকাতিয়া নদীর উত্তর তীরে খান বাহাদুর বাড়িতে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী জন্মগ্রহণ করেন। নবাব ফয়জুন্নেছার জন্ম ১৮৩৪ সালে। নবাব ফয়জুন্নেছার পিতার নাম সৈয়দ আহম্মদ আলী চৌধুরী। তার মাতার নাম আরফান্নেছা চৌধুরানী। ফয়জুন্নেছার ভাই বোনদের মধ্যে তিনিই জমিদারি পরিচালনার প্রশিক্ষণ পান। তৎকালীন হোমনাবাদ পরগনার বিরাট জমিদারি তিনি পরিচালনা করেন। নবাব ফয়জুন্নেছার গৃহশিক্ষক ছিলেন তাজ উদ্দিন। তিনি বাংলা, আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তার জমিদারির ১১টি কাচারির মধ্যে প্রত্যেকটির পাশে বিশুদ্ধ পানির জন্য পুকুর কাটান এবং মক্তব ও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
সাহিত্য চর্চায় নবাব ফয়জুন্নেছার প্রতিভা দুনিয়ার মানুষ সম্মানের সঙ্গে স্বীকার করে। কুমিল্লা শহরে ১৮৭৩ সালে নবাব ফয়জুন্নেছা দুটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। শহরের পূর্বপ্রান্তে নানুয়া দীঘিরপাড়ে প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় এবং অপরটি বাদুরতলাতে উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু শিক্ষা বিস্তারেই নয়। নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন একজন সাহিত্যনুরাগী। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কবি। তার রচিত রূপজালাল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। রূপজালাল কাব্যগ্রন্থ তার স্বামী গাজী চৌধুরীর নামে উৎসর্গ করেন। লেখিকাদের পথ প্রদর্শক ছিলেন নবাব ফয়জুন্নেছা।
সাহিত্যের ইতিহাসে এটি এক বিরল দৃষ্টান্ত। মিশ্র ভাষারীতির লেখা গদ্য ও পদ্যে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। এ কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও ফয়জুন্নেছার সংগীতসার ও সংগীত লহরী নামে দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুধাকর ও মুসলমান বন্ধু পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অসাধারণ উদ্যমী ফয়জুন্নেছাকে ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়া বেগম উপাধি দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ‘বেগম স্ত্রীলিঙ্গ বলেই তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরে রানী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে ফয়জুন্নেছাকে নবাব উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে খেতাব পাওয়া প্রথম মুসলিম মহিলা জমিদার।
নারী শিক্ষার প্রসারে অনন্য ভূমিকার পরও নবাব ফয়জুন্নেছাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বিগত ২০০৪ সালে একরকম অবহেলা ও অসম্মান করেই ফয়জুন্নেছাকে (মরণোত্তর) যৌথভাবে একুশে পদক দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে জাতীয় জাদুঘরে বেগম রোকেয়া ও বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের পাশে করা স্থাপন করা হয় ফয়জুন্নেছা কর্নার। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন নির্বাচিত সরকারের আমলেও নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী তার কর্মের স্বীকৃতি পাননি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। নারী শিক্ষার প্রসারে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হয়নি। বর্তমান সময়ে মহীয়সী নারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বীকৃত বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর আগে অন্ধকার যুগে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রনায়ক নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারীদের জন্য উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দুঃসাহস দেখিয়েছেন।
নবাব ফয়জুন্নেছা ছিলেন অন্ধকার যুগের আলোর দিশারি মহীয়সী নারীর স্মৃতি বহন করছে। নবাব ফয়জুন্নেছা ১৮৯৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্নে নবাব ফয়জুন্নেছা প্রচুর অর্থ সাহায্য করেন। নবাব ফয়জুন্নেছার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি ওয়াকফে দান করা হয়। কুমিল্লায় নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ফয়জুন্নেছা ছাত্রীনিবাস, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ফয়জুন্নেছা হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ফয়জুন্নেছা হল, কুমিল্লা সদর হাসপাতাল ফয়জুন্নেছা ম্যাটারনিটি ওয়ার্ড, লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ, নবাব ফয়জুন্নেছা ও বদরুন্নেছা যুক্ত উচ্চবিদ্যালয়-সহ অনেক প্রতিষ্ঠান তার স্মৃতি বহন করছে। জনহিতৈষী ব্যাপক কর্মজজ্ঞের পর অবশেষে ১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ১৩১০ বাংলা ২০ আশ্বিন এই মহীয়সী নারী চির নিদ্রায় শায়িত হন লাকসামে তারই নির্মিত জামে মসজিদের পাশে।