ঢাকা শনিবার, ০১ নভেম্বর, ২০২৫

রাজা ধানে সর্বস্বান্ত কৃষক জয়পুরহাটের আক্কেলপুর

চৈতন্য চ্যাটার্জী, আক্কেলপুর
প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৫, ০১:৪৮ এএম

উচ্চ ফলনের আশায় আমন মৌসুমে রাজা ধান লাগিয়েছিলেন জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার কৃষকেরা। সেই আশা আজ পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। বীজ কোম্পানির আশ্বাসে যে ‘ব্র্যাক-১৮ রাজা ধান’ চাষ করেছিলেন তারা, সেই ধান এখন খেতে শুকিয়ে খড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে পরিশ্রমের ফল ধ্বংস হতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকেরা। সেই সঙ্গে ঋণের বোঝায় জর্জরিত তারা।
উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের আবাদপুর গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম এবার রাজা ধান চাষ করে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তার কথায়, এই ধান বিক্রি করে ছেলের লেখাপড়ার খরচ আর মা-বাবার চিকিৎসা করাব। দোকানদার বলল, এই ধান নাকি খুব ভালো ফলন দেবে, গাছও হবে শক্ত। তবে ধান লাগানোর পর ধানের গাছ সতেজ ও শীষ ভরা ছিল। বিঘাপ্রতি ২৫ থেকে ২৭ মণ ধান হওয়ার কথা থাকলেও এখন জমির ৮০ শতাংশ শুধু শুকনো ধানের গাছ। সব শেষ হয়ে গেছে তার।
রফিকুলের মতো একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন রামশালা, কাঁঠালবাড়ী, ভিকনী ও পশ্চিম আমুট্টসংলগ্ন খাদাইল মাঠের অনেক কৃষক। তারা সবাই ‘রাজা ধান’ নামের একই জাতের বীজ ব্যবহার করেছিলেন। শুরুতে চারা গাছ ছিল সতেজ, পুষ্ট ও শীষে ভরা। কৃষকেরা আশায় বুক বেঁধেছিলেনÑ চলতি আমন মৌসুমে হয়তো কিছুটা লাভের মুখ দেখবেন। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সবুজ মাঠে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। প্রথমে কিছু গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়, এরপর গোড়া থেকে শুকিয়ে যেতে থাকে। কয়েক দিনের মধ্যে বেশির ভাগ জমির ধানগাছ মরে যায়।
কৃষক লতিফুর রহমান বলেন, কলেজ বাজার থেকে বেশি ফলন হবে এমন আশ্বাস পেয়ে ‘মজিবর বীজ ভান্ডার’ থেকে আমন মৌসুমের জন্য ব্র্যাকের রাজা ধানের বীজ কিনে এনেছিলাম। ধান লাগানোর পর গাছ সতেজ ও শীষ ভালো ছিল। কয়েক দিন যেতে না যেতে গাছ শুকিয়ে মরে যেতে লাগে। তার আগে দোকানির পরামর্শে নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করতাম। স্প্রে বা পোকার কারণে ক্ষতি হলে তো ধানগাছের ওপরের অংশে (শীষ-পাতা) ক্ষতি হতো, কিন্তু এখন মাঠে ধানের গাছই তো বাঁচল না।
কৃষক মো. শাহিনুর ইসলাম জানান, বিঘাপ্রতি ২৫ থেকে ২৭ মণ ধানের আশায় রাজা বাবু বীজ কিনি। ধান লাগানোর পর এমিস্টার টপ, এনসিপিওসহ বিভিন্ন কিটনাশক  দিয়েছি। দেড় বিঘায় ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা খরচ করেছি। ধানের গাছ এখন পুড়ে যাওয়ায় আমিও নিঃস্ব হয়ে গেছি। রাজা ধান লাগিয়ে আমরা প্রতরণার শিকার হয়েছি। আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ করেছি।
মজিবর বীজ ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী মো. মজিবর রহমান (মজু) বলেন, ‘আমি এই বীজ ব্র্যাক থেকে এনেছি। তারা বীজের বিষয়ে আমাকে যা বলেছিল, কৃষককে বীজ দেওয়ার সময় আমিও তাই বলেছি। এখন কৃষকদের কাছ থেকে যে অভিযোগ পেয়েছি, তা ব্র্যাক অফিসে জানিয়েছি।
ব্রাক জয়পুরহাটের সিনিয়র টেরিটোরি অফিসার আসাদুজ্জামান খান বলেন, ব্র্যাকের রাজা ধান-১৮-এর ব্যাপারে আমরা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. ইমরান হোসেন বলেন, রাজা ধান লাগিয়ে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মৌখিকভাবে অভিযোগে পেয়েছি। প্রথমিকভাবে তদন্ত করে এই ধানের জন্য কৃষকেরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তার সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রয়োজনে গবেষণাগার থেকে তদন্ত টিম নিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখব। যদি রাজা ধানের বীজের সমস্যা হয়, তাহলে আমরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আবিদা খানম বৈশাখী বলেন, ছবিসহ একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ব্র্যাক ধান-১৮ উপজেলার কৃষকেরা লাগিয়েছেন। তাদের বলা হয়েছিল এটি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। কিন্তু কৃষকেরা অভিযোগ করছেন, তাদের ধানের গাছ মরে যাচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসারের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কমিটি গঠন করব এবং তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর অভিযোগের সতত্যা পাওয়া গেলে বিধি মতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।