চলছে কার্তিক মাস, চারদিকে বইছে হেমন্তের হিমেল হাওয়া। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ইটভারটার কর্মব্যস্ততা। ইট তৈরি, নতুন ভাটা নির্মাণ, শ্রমিক নিয়োগ, মাটি কেনাবেচাÑ সব মিলিয়ে ভাটাগুলোতে চলছে ইট তৈরির তোড়জোড়। তবে আইন মানছেন না কোনো ভাটামালিক। লক্ষ্মীপুরের দুটি উপজেলায় মাত্র দুটি ভাটার অনুমোদন থাকলেও চলছে ৫১টি। এর সব কটির অবস্থানই ফসলি জমিতে।
জেলার রামগতি ও কমলনগরে ফসলি জমি ও বসতি এলাকায় অবৈধ ৪৯টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মালিকেরা ‘প্রশাসনকে ম্যানেজ’ করে চলতি মৌসুমে পুরোদমে ভাটার কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রামগতিতে ইটভাটা ছিল ৪০টি। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯টিতে। চলতি বছর আরও দুটি বাড়ায় বর্তমানে ৫১টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে রামগতির চর রমিজ ইউনিয়নেই রয়েছে ৪০টি ইটভাটা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতি বছরই এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে লোকদেখানো অভিযান চালায় প্রশাসন। কিন্তু এই অভিযানে কোনো ভাটা বন্ধ হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক জরিমানা করে প্রশাসন চলে যায়। যাওয়ার পরপরই আবার পুরোদমে ইটভাটার কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যকর অভিযান থাকলে অবৈধ ইটভাটা স্থাপনে মালিকেরা নিরুৎসাহিত হতেন।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, লোকালয়, কৃষিজমি ও টিলার নির্দিষ্ট দূরত্বে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। কৃষিজমির মাটি দিয়ে ইট তৈরিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আইনের ৫ (১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছেÑ ইট তৈরির জন্য পাহাড়, টিলা ও কৃষিজমি থেকে মাটি নেওয়া যাবে না। এ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদ-, ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ- হতে পারে।
তবে এসব আইন শুধু কাগজে-কলমেই। দুই উপজেলার ভাটার মালিকদের কেউ এ আইন মানছেন না। সব ভাটার আশপাশেই রয়েছে মানুষের বসতবাড়ি ও কৃষিজমি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, তারা এসব ভাটা বন্ধের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন করেছেন। উপজেলা প্রশাসনকেও লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে মালিকদের প্রভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে প্রশাসনের নাগের ডগায় এসব ইটভাটা গড়ে উঠছে। উপজেলার এসব ইটভাটা নিয়ে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
রামগতি উপজেলার একটি ইটভাটার শ্রমিক রহমান বিশ্বাস বলেন, ইটভাটাগুলোতে কাজ শুরু হয় অক্টোবরের শুরুতে। ইট তৈরি, নতুন ভাটা নির্মাণ, মাটি কেনাবেচাÑ সব মিলিয়ে ভাটাগুলোতে ইট তৈরির ভরা মৌসুম চলছে।
স্থানীয় চর আফজল গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, গ্রামে একসময় ধান ও সবজির জমি ছিল। এখন সেখানে সারি সারি ইটভাটা। জমির মাটি (টপ সয়েল) কেটে নেওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
একই এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, চর রমিজ ইউনিয়নে ৪০টি ইটভাটা। ভাটার কারণে সাত মাস (নভেম্বর থেকে মে) লোকজন চরম দুর্ভোগে বসবাস করেন। ভাটার ধোঁয়ায় বাতাস দূষিত হয়ে যায়। গত ছয় বছর ধরে তার গলায় চর্মরোগ দেখা দেয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তবে বর্ষা মৌসুমে ভাটা বন্ধ থাকলে তার চর্মরোগ কিছুটা কমে যায়।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে রামগতিতে অবৈধ ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলার চর রমিজ ইউনিয়নের চর আফজল গ্রামের আমানত ব্রিক্স (এএমএ) ও জেএসবি ব্রিক্স ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি ভেকু মেশিনের সাহায্যে ভাটার চুল্লি, চিমনি এবং কাঁচা ইট বিনষ্ট করে দেওয়া হয়ে। এ সময় ভাটার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে অভিযানে অংশ নেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক জমির উদ্দিন, ঢাকা কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশিকুর রহমান, লক্ষ্মীপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠান, রামগতি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জানতে চাইলে ইউএনও সৈয়দ আমজাদ হোসেন বলেন, রামগতি ও কমলনগরে ৫১টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৪৯টি ভাটা অবৈধ। সেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হয়েছে। ছয় দিন ধরে চলবে এই অভিযান। অবশ্য ভাটাগুলো বন্ধে আগে মাইকিং করা হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রচারও চালানো হয়। অবৈধ ভাটা ভেঙে দেওয়ার পরেও যাতে চালু করতে না পারে, সে জন্য অভিযান অব্যাহত থাকবে।
লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠান বলেন, জেলাতে শতাধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলোতে অভিযান চালানো হবে। অভিযানের প্রথম দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুটি ভাটা বিনষ্ট করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন