ময়মনসিংহের ভালুকার ভরাডোবা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে গড়ে উঠেছে সুতা ও কাপড় রং করার (ডাইং) মিল। যেখানে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রং, কেমিক্যাল এবং রাসায়নিক দ্রব ব্যবহার করে কাপড়ে রং করা হয়। ফলে গত ১৫ বছরে কারখানা থেকে নেমে আসা বিষাক্ত বর্জ্যরে পানির কারণে ৩৩৬ একর জমিতে বোরো আবাদ বন্ধ রয়েছে। ফলে ফসলি জমিতে আবাদ করতে না পেরে একদিকে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ভরাডোবা গ্রামে মুলতাজিম মিল ও পাকিস্তানি মিল হিসেবে পরিচিত ‘এক্সপিরিয়েন্স টেক্সস্টাইল মিল’ নামে ডাইং ফ্যাক্টরি থেকে গত দেড় দশক ধরে বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি স্থানীয় খাল-বিলে নামার কারণে কয়েকটি গ্রামের শত শত কৃষকের বোরো আবাদ বন্ধ রয়েছে। এসব মিলের বিষক্ত পানি নেমে তরফদারবাড়ীসংলগ্ন কাকাচড়া বিল, সাধুয়া বিল, খুরোলিয়া বিল, তালতলা, কেচুরগোনা, মেলেন্দা, দক্ষিণ ভরাডোবার হায়রা বিল, তেইরা বিলসহ পুরুড়া ও ভাটগাঁও গ্রামের বেশ কয়েকটি বিলের পানি ও মাটি নষ্ট হওয়ায় বোরো আবাদ বন্ধ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভরাডোবা গ্রামের একজন কৃষক জানান, দীর্ঘদিন পাকিস্তানি ও মুলতাজিম মিলের দূষিত পানি বিলে নেমে তাদের বোরো জমি তলিয়ে দেওয়ায় আবাদ করতে পারছেন না। অন্যদিকে বর্জ্যমিশ্রিত দূষিত কালো পানি নিচের স্তরে গভীরে নলকূপের পানির সঙ্গে মিশে খাওয়ার পানি অনিরাপদ করে তুলছে। এলাকার কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির মদতপুষ্ট হয়ে মিল কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছেমতো স্থানীয় খালবিলে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে কৃষকের ফসল নষ্টসহ পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে। এর ফলে আবাদি জমি নষ্টের পাশাপাশি প্রায়ই পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে এলাকার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
ভরাডোবা ডিমাইল পাড়ার এক কৃষক জানান, বিলের কালো কুচকুচে পানিতে নামলে শরীরে আলকাতরার মতো পদার্থ লেগে চুলকাতে থাকে। ধান রোপণ করলে গোছা বড় হয়ে গোড়া পচে গাছ মরে যায়।
এদিকে দীর্ঘদিন কালো পানিতে বিল ডুবে থাকায় কচুরিপানায় ছেয়ে গেছে। বর্জ্য পানির বিষাক্ত দুর্গন্ধে বাড়িঘরে থাকা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বর্জ্য পানি বন্ধের দাবিতে এলাকার শত শত কৃষক প্রতিবাদ করে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েও স্থায়ী সমাধান পাননি।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানায়, ভরাডোবা ইউনিয়নের কয়েকটি ডাইং মিলের বর্জ্যরে কারণে দীর্ঘদিন ধরে শত শত কৃষকের বোরো আবাদ বন্ধ রয়েছে। এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পক্ষ থেকে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে তদন্তের জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রধান করে উপজেলা কৃষি অফিসার, মৎস্য অফিসার, সমাজসেবা অফিসার, চারটি মিলের প্রতিনিধি ও কৃষক প্রতিনিধি রহুল আমিনসহ বেশ কয়েকজনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি গত ৯ জুলাই তেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও মিল কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে পর পর চার দফা গণশুননি করেন। এতে ভরাডোবা ইউনিয়নের ভরাডোবা, পুরুড়া, রাংচাপড়া ও ভাটগাঁও গ্রামের কৃষি ব্যাংকে মোট ৩৩৫ দশমিক ৭৪ একর জমি অনাবাদী হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। উৎপাদন ব্যয় ছাড়াই প্রতি একর জমির জন্য বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ৬৬ হাজার টাকা ধার্য করা হয়। সেই হিসাবে গত ১৫ বছরে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৩ কোটি ২৮ লাখ ১০ হাজার টাকার মতো।
তদন্ত কমিটির দেওয়া সুপারিশে কৃষকদের ক্ষতিপূরণের টাকা শতকরা ২৫ শতাংশ মুলতাজিম মিল ও ৭৫ শতাংশ টাকা এক্সপিরিয়েন্স মিল কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করবে। তবে কৃষকদের ক্ষতিপূরণের টাকা মিল কর্তৃপক্ষ পরিষোধ না করায় তারা পুনরায় গত ২৯ অক্টোবর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান।
এসব বিষয়ে মুলতাজিম মিল ও এক্সপিরিয়েন্স মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগযোগের চেষ্টা করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হননি। এ কারণে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে ইউএনও হাসান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টি ফয়সালার চেষ্টা চলছে। ফয়সালা সম্ভব না হলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন