ঢাকা সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ইশার নার্স থেকে ফেন্সার হওয়ার গল্প

স্পোর্টস রিপোর্টার
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫, ০৮:৪৭ এএম
এমিলি রায় ইশা

এমিলি রায় ইশা মিরপুরের সাইক নার্সিং কলেজের ছাত্রী। তার কাজ হচ্ছেÑ চিকিৎসাপত্র, ওষুধ কিংবা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকা। তবে তরবারি হাতেও একজন সফল ফেন্সার হওয়ার নজির দেখালেন ইশা। গত শনিবার শেষ হওয়া জুলাই রেভল্যুশন ফেন্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতেছেন মিরপুরের এই তরুণী। মিরপুর ফেন্সিং ক্লাবের হয়ে এত দিন খেললেও এবার আনসারের জার্সিতে মেয়েদের ফয়েল এককে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন এই ফেন্সার। নার্স থেকে সফল ফেন্সার হওয়ার গল্পটা নিজেই জানালেন ইশা।

প্রথম দিকে ফেন্সিং খেলাটা কেমন প্রকৃতির, সেটিই জানা ছিল না ইশার। ২০২১ সালে যখন মিরপুর বাঙলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তেন, তখন ফেডারেশনের দুই কোচের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বাঙলা কলেজে জুনিয়র ফেন্সার খুঁজতে গিয়েছিলেন ফেন্সিং ফেডারেশনের কোচরা। তরবারি দিয়ে মারামারির খেলার ডেমোনেস্ট্রেশন দেখে খেলাটির প্রতি আগ্রহ বাড়ে ইশার। এরপর ২০২২ সালে প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েই জুনিয়র বিভাগে স্বর্ণপদক জিতে করেন বাজিমাত ইশা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মিরপুর ক্রীড়া পল্লীতে চলছে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের ক্যাম্প। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলের ক্যাম্পেও একমাত্র জুনিয়র হিসেবে ডাক পেয়েছেন তিনি।

এবারের জুলাই রেভল্যুশন চ্যাম্পিয়নশিপে সিনিয়র ও অভিজ্ঞদের জয়-জয়কার। তারপরও তিনি অন্তত স্বর্ণপদক জিততে চেয়েছিলেন। ব্রোঞ্জ জিতে স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ ইশার, ‘আমি নিজের খেলায় সন্তুষ্ট না। কারণ, যেভাবে প্র্যাকটিসে খেলি, সেভাবে খেলতে পারিনি। আরও ভালো করতে পারতাম। কিন্তু এখানে অনেক নার্ভাস হয়ে পড়ি। সিনিয়রদের হারাতে পারব কি পারব না- এই ভয় পেয়ে বসেছিল।’ ইশার বাবা রিচার্ড রায় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। শুরুতে মেয়েকে ফেন্সিংয়ে আসতে দিতে চাইতেন না। কিন্তু যতই দিন গড়িয়েছে, মেয়েকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। ইশা বলেন, ‘প্রথম দিকে বাবা সমর্থন দিতেন না। কারণ, এটা ব্যয়বহুল খেলা। যে ব্লেড দিয়ে খেলি, এটা প্রায়ই ভেঙে যায়। ইকুইপমেন্ট কিনে দিতেন না বাবা। বলতেন, এটা খেলে কী হবে? যদিও এখনো তত ফেমাস না খেলাটা। প্রথম দিকে সমর্থন দিতেন না। কিন্তু যখন দেখলেন যে, আমি নিয়মিত ভালো করছি, তখন সাহস জোগাতেন। উৎসাহ দিতেন। আমি খারাপ খেললে কষ্ট পান বাবা।’ ফেন্সিং মারামারির খেলা হলেও কখনো ইনজুরিতে পড়েননি ইশা। তিনি বলেন, ‘খেলার সময় সেভাবে ইনজুরিতে পড়িনি। এই খেলায় এত বড় আঘাত কখনো লাগে না। অনেক নিরাপদ খেলা। সেফটি মেনটেইন করে খেলি। ছোটখাটো আঘাত লাগলেও পরে ঠিক হয়ে যায়।’ ২০২২ সালে প্রথমবার জুনিয়রে স্বর্ণপদক জেতার ঘটনাটা এখনো মনে পড়ে ইশার। তিনি বলেন, ‘ওই দিন স্বর্ণপদক জয়ের পর বাবা আনন্দে কান্না করে দিয়েছিলেন। আত্মীয়-স্বজনদের সবাইকে ফোন দিয়ে বলেন, দেখো আমার মেয়ে ন্যাশনালে স্বর্ণপদক জিতেছে।’ এত খেলা থাকতে কেন ফেন্সিং বেছে নিলেন? এমন প্রশ্নে বলেন, ‘আসলে যখন প্রথম আসি, তখন কিছু বুঝতাম না। ফেন্সিং নাম তখন প্রথম শুনি। জাহিদ স্যার ও ফারুক স্যার ডেমোনেস্ট্রেশন দেখালেন কলেজে। এরপর খেলতে খেলতে ভালো লেগে যায়। এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং খেলা। যখন ভালো করতে শুরু করি, তখন ভালো করার পিপাসা আরও বেড়ে যায়।’ ২০২২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর নার্সিংয়ের কোর্সে ভর্তি হন ইশা। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রচুর কষ্ট করা লাগে। কলেজে ৮০ ভাগ উপস্থিত থাকা লাগে। যদিও পড়াশোনায় আমি ভালো। সিজিপিও ভালো। খেলা ও পড়া দুটোই সমানভাবে মেইনটেন করি। তা ছাড়া আমার ক্লাসমেটরাও অনেক হেলপফুল। তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেখে কখনো কোনো মেডিকেল স্টুডেন্ট খেলাধুলা করছে ও পড়াশোনা করছে এটা বিরল। আমি খেলতে পেরে গর্বিত। আমার কোচ মনির স্যারও আমাকে নিয়ে গর্বিত।’ এসএ গেমসের ক্যাম্পে ডাক পাওয়ায় যদিও কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছেন ইশা, ‘স্যারদের কাছে অ্যাপ্লিকেশন করি। বলেছি আমি ক্যাম্প করতে চাই। এবং পড়তেও চাই।

প্রিন্সিপাল স্যার বলেছেন, তুমি ছুটিতে থাকো। তবে মিডটার্ম দিয়েছি ২৬ আগস্ট। আমি নার্সিং ও খেলা দুটোই উপভোগ করছি।’ এরপর তিনি বলেন, ‘ফেন্সিং আমার ভালোবাসা। তবে শুধু বাবা-মায়ের জন্য পড়াশোনা করছি।’ ইশা জানেন, ফেন্সিংয়ে নয়, শেষ পর্যন্ত নার্সিংয়েই ক্যারিয়ার গড়তে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ফেন্সিং নিয়ে বেশিদূর যাওয়ার সুযোগ নেই। তবু বলে যান, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নার্সিংকেই বেছে নিতে হবে। এখানে ফেন্সিংয়ে ভালো কিছু করলেও কতটাই বা সুযোগ পাব?’ তারপরও ইশা স্বপ্ন দেখেন, এসএ গেমসে তার গলায় উঠবে স্বর্ণপদক। বাজবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’