ঢাকা বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৫

এই মুশফিক সবার জন্য উদাহরণ

মাঠে ময়দানে প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৫, ০২:৩৩ এএম

আজ মিরপুরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০তম টেস্ট ম্যাচ খেলার মাইলফলক স্পর্শ করতে যাচ্ছেন মুশফিকুর রহিম। ২০০৫ সালে লর্ডসের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন এই উইকেটরক্ষক ও ব্যাটসম্যান। ২০ বছর ধরে নানা বাধা অতিক্রম করে ১০০তম টেস্ট ম্যাচ খেলার মাইলফলক স্পর্শ করার মঞ্চে এসে হাজির হয়েছেন এই ক্রিকেটার। ১৮ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে আঙিনায় পা রাখা মুশফিক আজ থেকে নিজেই এক ইতিহাস হতে যাচ্ছেন। বিশে^র ৮৪তম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০তম টেস্ট ম্যাচ খেলবেন তিনি। তার এখানে আসার পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। তার ক্যারিয়ারের সাক্ষী অগণিত কাকডাকা ভোর, শিশিরভেজা হোম অব ক্রিকেট মিরপুরের প্রতিটি ঘাস। সাক্ষী তার শুরুর সময়ের সঙ্গীরাও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মুশফিকের অভিষেক টেস্টের অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন। তার মতে, এই মুশফিক সবার জন্য উদাহরণ। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এবং মোহাম্মদ আশরাফুল ও খালেদ মাসুদ পাইলট মুশফিকের শততম টেস্ট নিয়ে কথা বলেছেন।

হাবিবুল বাশার সুমন :

জাতীয় দলে আসার পরই মুশফিক যে দেশের ক্রিকেটের রতœ হতে যাচ্ছেন, সেটি ধারণা করতে পেরেছিলেন বাশার। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথম দিন থেকেই একটা জিনিস নিয়ে কথা বলতাম, ছেলেটা টেকনিক্যালি ভালো। ব্যাটিং টেকনিক খুব পরিষ্কার। মনোযোগী ও পরিশ্রমী। খেলার প্রতি ওর আগ্রহ এতটাই ছিল যে শুরু থেকেই সেটা চোখে পড়ত। আজ যে ও বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শততম টেস্ট খেলছে, এর কৃতিত্ব ওকেই দিতে হবে। আমার মনে হয়েছে, সময় যত গেছে, ওর পরিশ্রম আরও বেড়েছে। অন্যরা যেখানে বছরের পর বছর খেলার সময় একটা পর্যায়ে ফিটনেস বা মনোযোগে ঢিল দেয়, মুশফিক উল্টো পথ ধরেছে। একাগ্রতা, শৃঙ্খলা, ত্যাগ, কঠোর পরিশ্রমÑ সবকিছু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও তীক্ষè হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই মুশফিক ছিল লাজুক স্বভাবের। আমরা যারা সিনিয়র, মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করেই দুষ্টুমি করতাম, যাতে ও সহজ হতে পারে। আমরা শয়তানি করলেই লজ্জায় লাল হয়ে যেত ও। ওকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে আমরা সবাই চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও শুরুতে খুব টেনশনে থাকত, আর টেনশন থাকলেই ভুল বেশি হয়। সেই চাপ কমানোর জন্যই আমরা তাকে হালকা পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করতাম।’ বাশার মনে করেন, মুশফিকের শততম টেস্ট খেলা কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়। ১০০ টেস্ট যারা খেলেছে, তাদের নামের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তারা কারা খেলেছে। বাশার বলেন, ‘সবাই কিংবদন্তি। আর আমাদের দেশে টেস্ট ম্যাচ খেলা তো কঠিন ব্যাপার। কারণ আমরা শুরুতে বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতাম না। আমরা তো আসলে ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো এত টেস্ট ম্যাচ খেলার মতো অবস্থায় ছিলাম না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখান থেকে এত দিন ধরে খেলে এ পর্যন্ত আসার জন্য আমি মুশফিককে স্যালুট জানাই। খুবই কঠিন কাজ। এতদিন ধরে ফিট থাকা। পারফর্ম করা। আমাদের মতো দেশের জন্য এটা অনেক কঠিন। সেটা ওর মাধ্যমে হতে যাচ্ছে দারুণ ব্যাপার। ও আমাদের সবার জন্য একটা উদাহরণ তৈরি করল যে ত্যাগ, পরিশ্রম, পারফর্ম করলে দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেলা যায়। নতুন যারা উঠে আসছে, তাদের জন্য মুশফিক একটা উদাহরণ। তার মতো হওয়া সহজ ব্যাপার না। সবকিছু ছেড়ে ক্রিকেটের পেছনে লেগে থাকাটা সহজ ব্যাপার না।’

মোহাম্মদ আশরাফুল :

মুশফিককে ভাগ্যবান বলছেন সাবেক অধিনায়ক এবং বর্তমানে জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ মোহাম্মদ আশরাফুল। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ এমন সুযোগ দিয়েছেন যে মুশফিকের অভিষেকের সময় লর্ডসে আমি ড্রেসিং রুমে ছিলাম, আর এখন তার ৯৯তম ও ১০০তম টেস্টেও আমি আবার সঙ্গে আছি। একই খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারের এমন দুটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সাক্ষী হওয়া বিরল সৌভাগ্য আমার জন্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুশফিককে আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন ধারাবাহিকতা খুব কম দেখা যায়, আর এটা সম্ভব হয়েছে শুধু একটি কারণে, তার অতুলনীয় শৃঙ্খলা। বিশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা কোনো সহজ কথা নয়। যারা খেলছে বা সামনে খেলবে, তাদের সত্যিই মুশফিককে রোল মডেল হিসেবে দেখা উচিত। খাবার, ঘুম, ফিটনেস, অনুশীলনÑ প্রতিটা জায়গায় ওর শৃঙ্খলা ছিল নিখুঁত, আর সেটাই তাকে আজকের অবস্থানে এনেছে।’ মুশফিকের নানা অর্জন রয়েছে টেস্ট ক্রিকেটে। এ প্রসঙ্গে আশরাফুল বলেন, ‘বাংলাদেশের তিন ফরম্যাটে নেতৃত্ব দিয়েছে সে। দেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ানও মুশফিক। ২০১৩ সালের পর থেকে যখনই সেঞ্চুরি করেছে, সেটা বেশির ভাগ সময়ই বড় ইনিংসে রূপ নিয়েছে। এখনো দারুণ ফর্মে আছে; জাতীয় লিগেও শতক করেছে সবশেষ ম্যাচটাতে। আশা করি, মিরপুরে শততম টেস্টে আরেকটা স্মরণীয় ইনিংস খেলবে। ঐতিহাসিক ম্যাচটাও রাঙাবে। আমার মনে হয়, মুশফিকের মতো ক্রিকেটারের জন্য শুধু স্টেডিয়ামে একটা স্ট্যান্ড নয়, এর চেয়েও বড় কিছু থাকা উচিত। এমন ক্রিকেটাররা দেশের ক্রিকেটের পরিচয়।’

খালেদ মাসুদ পাইলট :

ছোট বয়স থেকেই মুশফিক আভাস দিয়েছিলেন, দেশের ক্রিকেটের সম্পদ হতে যাচ্ছেন তিনি। খালেদ মাসুদের মতে, মুশফিকের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার মানসিক শক্তি। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক ম্যাচে দেখেছি, চাপ বাড়ছে, ড্রেসিং রুমে সবার মনে অস্থিরতা, কিন্তু ওর মুখে সেই শান্ত, দৃঢ় অভিব্যক্তি। যেন বলছে, ‘আছি, চিন্তা নেই।’ খুব কম ক্রিকেটারের মধ্যে এটা পাওয়া যায় যে শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো দলের আত্মবিশ্বাসও টেনে তোলে।’ খালেদ মাসুদ আরও বলেন, ‘আরেকটা দিক আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে, তার পেশাদারিত্ব। খেলার বাইরে নানা প্রলোভন থাকে, কিন্তু মুশফিকের জীবনে সেগুলোর জায়গা নেই। খাবার, বিশ্রাম, ট্রেনিংÑ সবই এক নিখুঁত ছকে চলে। নতুনরা যখন আমার কাছে শেখার কথা বলে, প্রথম উদাহরণ হিসেবেই মুশফিকের কথা বলি। শততম টেস্ট একটা সংখ্যার ঘটনা নয়। এটা বলে দেয়, মুশফিক কতটা নিবেদিত, কতটা স্থায়ী শক্তি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। তাকে দেখে বোঝা যায়, অধ্যবসায় আর ইচ্ছাশক্তি মিললে কীভাবে একজন ক্রিকেটার সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকে।’