অসময়ে পা বাড়ালেই মৃত্যুঝুঁকি! এমনই এক দুর্গম জলপ্রপাত ‘কামংজয়’। ( কধসড়হম ঔড়ু ডধঃবৎভধষষ ) যেটা সবার কাছে বরইতলী ঝর্ণা নামে পরিচিত। সবুজ বনানীর উঁচু উঁচু শৈলের পাঁজর ভাঙা জল ছিটকে পড়ে প্রায় ৩০-৪০ ফুট উপর থেকে। মাঝারি আকারের হলেও পাশাপাশি একাধিক জলপ্রপাত থাকায় এটি হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয়, যা সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। চৌদিকের শৈলচূড়ায় তাকালে মনে হয় যেন দাঁড়িয়ে আছি এক মৃত্যুকূপে, আর আমার দিকে ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে জলকণা। পানির স্রোতের কলকল ধ্বনি কানে বাজলেও জলপ্রপাতের চারপাশ খুবই সুনসান এক ভয়ানক পরিস্থিতি। এমনই এক দুর্গম পথে আমরা ছিলাম ৫ জন- আমি, এম মহিউদ্দিন, ওসমান গণি, ইব্রাহিম খলিল ও মোহাম্মদ আজিজ।
ভৌগোলিক অবস্থান:
কামংজয় জলপ্রপাত- বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চল, পর্যটননগরী কক্সবাজার শহরের পার্শ্ববর্তী এলকার পূর্বে বান্দরবান জেলার নাইক্ষংছড়ি উপজেলায়- জলপ্রপাতটি অবস্থিত। পর্যটকদের সরাসরি কক্সবাজার, রামু থেকে মরিচ্চা বাজার, এর পূর্বদিকে রাস্তা দিয়ে পাতাবাড়ী ক্রস করে বরইতলী বাজার যেতে হবে। ওখান থেকে হেঁটে পাথরে ভরা খালের ওপর দিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রায় মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত এই কামংজয় জলপ্রপাতের প্রচার ঘটে বরইতলী স্থানীয় লোকের মাধ্যমে।
ঝুঁকি ও উপায়:
ঢালু পাহাড়ের বুক চিরে আসা পাথরে ভরপুর ওই খালটির পানি পায়ের পাতার ওপর হলেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি এখানেই। পাথরের ওপরে জমা পিচ্ছিল মস ( ইৎুড়ঢ়যুঃধ প্রজাতির উদ্ভিদ ) এর কারণে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা অনেক। যাত্রাপথে এই শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ বড় বাধা। স্থানীয় লোকের সাক্ষাতে জানা যায়, পানিতে বড় বড় বিষাক্ত সাপ থাকে। তা ছাড়া আমরা লাল বিষাক্ত মাকড়সাও দেখেছি। জলপ্রপাতের কাছাকাছি গিয়ে খালটি অনেক সরু হয়ে যায়, তাই বৃষ্টির সময় পাহাড়ি ঢল আসলে বাঁচার সম্ভাবনা কম। এই ঝুঁকি থেকে বাঁচতে নির্বাচন করতে হবে সঠিক সময়। যে সময় বৃষ্টি কমে যায়, অর্থাৎ শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে যাওয়াটা ভালো। এতে পাহাড়ি ঢল থাকে না, ঝর্ণার পানি পরিষ্কার থাকে। তা ছাড়া সেই সময় পর্যটক থাকে বিধায় পথে কিছু উগ্র লোকদের দ্বারা হয়রানি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
অজ্ঞাত আমরা:
কামংজয় জলপ্রপাতে আমাদের প্রথম ভ্রমণ হওয়ায় আমরা ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ছিলাম। হাঁটতেই আছি অথচ পথের শেষ নেই, যেন মনে হচ্ছে উক্ত খালের শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। যাওয়ার পথে খালটির একাধিক শাখা থাকার কারণে আমরা অনেকটা বিভ্রান্তে ছিলাম কোনটা সঠিক পথ। কিন্তু আমরা যেটি মূল খাল সেটা ধরেই এগিয়ে গেছি, আর এতেই মিলেছে কামংজয় জলপ্রপাত, চারদিকে সবুজের সমারোহ আর ঘন অরণ্যের মাঝে যেন একটি প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু এটাই পর্যটকদের জন্য মৃত্যুকূপে পরিণত হয় ঘন বর্ষায় । আমরা রামু স্টেশন থেকে সকাল ৮ বাজে রওনা হলে গন্তব্যে পৌঁছি ১১:৩০ বাজে। আমরা অবশ্য পর্যাপ্ত খাবার নিয়েছিলাম। দুপুরের খাবার জলপ্রপাতের পাশে বসেই খাওয়া হয়। আসার পথে অনেক ফল যেমন পেয়ারা, লেবু, জাম্বুরা খেয়েছিলাম, যদিও এগুলো পাহাড়ি (স্থানীয়) মানুষদের দখলকৃত, তবে তারা বাধা দেয় না। পাথরে পাথরে পা রেখে খুব সতর্কতার সঙ্গে ফিরে আসলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়।
স্থানীয় সংস্কৃতি:
বরইতলী বাজার থেকে ঝর্ণায় যাওয়ার পথে পাহাড়ের গায়ে বসবাস করে- রাখাইন, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। যাদের নিজস্ব ভাষা, পোশাক, খাদ্য এবং উৎসব রয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল, সবজি, পান এবং মাছ চাষ করে জীবনযাপন করে। তাদের নিজস্ব ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও আয়ত্ত করেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে জলপ্রপাতের সঠিক পথ কোনটি তা নিশ্চিত হয়েছি। তাদের পাশাপাশি কিছুসংখ্যক মুসলিমও বসবাস করেন, কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে বাজার বা স্টেশনের ওপর নির্ভরশীল। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো পাহাড়ে সবকিছু উৎপাদন করে মানিয়ে নিতে তারা সক্ষম নন।
কামংজয়ের উদ্দেশ্যে:
একখ- অরণ্যের বুক দিয়ে ভেসে আসা এই জলপ্রপাত প্রায়ই সকল পর্যটকদের মন কেড়েছে। এত দুর্গম পথ অনেক কষ্টে পাড়ি দিয়ে জলপ্রপাতের নিচে দাঁড়ালে ভুলে যাই সে কষ্ট। সবুজের মাঝে পরিষ্কার জল প্রবাহিত হওয়ার দৃশ্য সচোক্ষে দেখলে মন এমনিতেই পুলকিত হয়ে যায়। পাথরের রাজ্য বেয়ে হাঁটার স্বাদই আলাদা। তবে খেয়াল রাখতে হবে শ্যাওলার দিকে।
চারদিক থেকে পতিত জল মাঝখান থেকে ঘাড় উঁচু করে দেখলে অপরূপ লাগে। পাথরের এপাশ-ওপাশ করে বয়ে যায় স্রোত। এর মাঝেই পুটি মাছের ছোটাছুটি দেখলে মন শান্ত হয়ে যায়। খালের পাশে পানের খেত, আমবাগান, পাহাড়ি কলাগাছ, লেবুবাগান এবং টংঘর। তারমধ্যে শৈলচূড়ায় সূর্যের স্বর্ণমুকুট, ভাদ্রের আকাশে আবার আকস্মিক মেঘ, আর তখনই ভীতির সঞ্চার। সব মিলিয়ে একটি উপভোগ্য ও বৈচিত্র্যময় পরিবেশ। ভালো না লাগার কোনো অবকাশ নেই।
আমাদের এই ভ্রমণটি খুবই আনন্দদায়ক ছিল, কারণ আমরা তেমন ঝুঁকির সম্মুখীন হইনি। তবে এই জলপ্রপাতে এসে পর্যটকদের প্রাণহানি ও হয়েছে। তখন থেকে প্রশাসন ওখানে যেতে বাধা দিলেও পরবর্তীতে পর্যটকরা আবারও যাওয়া শুরু করে। যদিও আগের তুলনায় অনেক কম। বৃষ্টির সময় স্রোত বেশি হয় যার কারণে সে সময় না যাওয়াটাই উত্তম। বৃষ্টির কিছুদিন পর বা বর্ষার শেষের দিকে জলপ্রপাতে যাওয়ার সঠিক সময় এবং সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে যাওয়া উচিত। অতিশয় সতর্কতার সঙ্গে যাওয়া হোক কামংজয় জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন