ঢাকা মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫

হাসিনার সীমান্ত সড়কে হুমকিতে বাংলাদেশ

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২৫, ০৯:২৯ এএম
ছবি: সংগৃহীত

দুর্গম পাহাড়ে উন্নয়নের নাম করে শুরু করা সীমান্ত সড়ক আজ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা সরকারের শুরু করা এই প্রকল্প মূলত ভারতের স্বার্থে নেওয়া হয়েছে বলেই মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। জনবসতি না থাকা এলাকাতেও বিশাল এই সড়ক নির্মাণ, পার্বত্য শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন, এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন- সব মিলিয়ে দেশবাসীকে পড়তে হতে পারে বড় ধরনের কৌশলগত বিপর্যয়ে।

অথচ বাস্তবে এই সড়কের বেশিরভাগ এলাকায় কোনো জনবসতি নেই। পরিবেশ ও পার্বত্য শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী শিল্প-কারখানা স্থাপনের যে কথা বলা হয়েছিল তা শুধুই গালগল্প। মূলত ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার লম্বা দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ কথিত সীমান্ত সড়ক প্রকল্প শুধু ভারতের স্বার্থেই গ্রহণ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার।

এই সড়কের কারণে তিন পার্বত্য জেলা এবং বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম নিয়ে নতুন করে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অথচ এ ধরনের সীমান্ত সড়কের নিরাপত্তা দিতে যে প্রস্তুতি দরকার ছিল তার কিছুই নেওয়া হয়নি এখনো। তবে জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পলায়নের পর এই সীমান্ত সড়কের ব্যবহার ও নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার।

তথ্য বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত আর মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে ভারতের সঙ্গে চার হাজার ১৫৬ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার। তবে ভারতের সঙ্গে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে তিন পার্বত্য জেলায়। ফেনী ও খাগড়াছড়ির রামগড় পয়েন্ট থেকে কক্সবাজারের ঘুনধুম পর্যন্ত এক হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত থাকলেও এই সীমান্ত নিয়ে সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি ছিল না কখনোই। কারণ প্রাকৃতিকভাবেই এই এলাকাটি ছিল দুর্গম। তাই বহিঃশত্রুর আক্রমণের কোনো শঙ্কা ছিল না এতদিন। ক্রস বর্ডার ক্রাইম বা সীমান্ত চোরাচালান রোধে বিজিবির কয়েকটি ক্যাম্প ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় ধরনের কোনো তৎপরতার প্রয়োজন পড়েনি কখনো। কিন্তু হালে সেই অবস্থা পাল্টেছে।

দুর্গম পাহাড়ে উন্নয়নের নাম করে শুরু করা সীমান্ত সড়ক আজ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা সরকারের শুরু করা এই প্রকল্প মূলত ভারতের স্বার্থে নেওয়া হয়েছে বলেই মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। জনবসতি না থাকা এলাকাতেও বিশাল এই সড়ক নির্মাণ, পার্বত্য শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন, এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন- সব মিলিয়ে দেশবাসীকে পড়তে হতে পারে বড় ধরনের কৌশলগত বিপর্যয়ে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেডের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতে নির্মিত হচ্ছে প্রায় ১,০৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক। এই সড়কের অবস্থান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমারেখা থেকে মাত্র ১৫০ থেকে ১,০০০ মিটার দূরে। অথচ সংশ্লিষ্ট এলাকায় কোনো উল্লেখযোগ্য জনবসতি নেই এবং শিল্প-কারখানা স্থাপনের মতো অবকাঠামোও নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত সড়ক প্রকল্প ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর (সেভেন সিস্টারস) সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক চাপের মুখে ফেলার কৌশলের অংশ।

ড. ছালেহ শাহরিয়ার বলেন, ‘এই প্রকল্প ভারতের বর্ডার কানেক্টিভিটি পরিকল্পনার সরাসরি প্রতিফলন। ‘চিকেন নেক’ বন্ধ হলে ভারতের বিকল্প পথ দরকার হবে, সেটাই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।’

অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্তির জন্য একটি কৌশলগত করিডোরে পরিণত হয়েছে। বিগত সরকার পরিকল্পিতভাবেই ভারতকে সুবিধা দিয়েছে।’

এদিকে এই সড়ক খুলে দেওয়ার মাধ্যমে যেসব দুর্গম এলাকা আগে প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত ছিল, এখন সেখানে আক্রমণ বা অনুপ্রবেশের শঙ্কা বেড়ে গেছে। সেনা কর্মকর্তাদের মতে, এতদিন সমতলের সীমান্ত এলাকায় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা করা হতো। এখন সেই পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহীদ উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষায়িত দুটি কম্পোজিট ব্রিগেড রিজার্ভ রাখতে হবে। বিজিবির পাশাপাশি নতুন একটি প্যারা মিলিটারি বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে, যারা পাহাড়ি ও সীমান্ত সড়ক বিশেষায়িতভাবে রক্ষা করবে।’

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বাভাবিক সময়ে সেনাবাহিনী সরাসরি সীমান্তে কার্যক্রম চালাতে পারে না। আবার পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাধ্যবাধকতায় তিন পার্বত্য জেলায় সেনা ক্যাম্পও বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখন কার্যত বিজিবির হাতে নির্ভরশীল, যাদের সক্ষমতা সীমিত।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন ধরনের এই সীমান্ত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ড্রোন, মনিটরিং যন্ত্র, এবং দ্রুত বিওপি স্থানান্তরসহ একগুচ্ছ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি।

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে তথাকথিত উন্নয়ন ও কানেকটিভিটির নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতপন্থি কৌশলের কেন্দ্রে পরিণত করেছে শেখ হাসিনার সরকার- এমন অভিমত গবেষক ও বিশ্লেষকদের।

এই সীমান্ত সড়ক এখন শুধুই একটি অবকাঠামোগত প্রকল্প নয়, বরং দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বড় হুমকির নাম হয়ে উঠেছে। এখন সময় এসেছে এই প্রকল্প নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে খোলামেলা বিতর্ক এবং সামরিক ও কূটনৈতিক পরিকল্পনায় আমূল পুনর্বিন্যাসের।