২০২৪ সালে তরুণদের পদচারণায় কেঁপে উঠেছিল ঢাকা শহর। ছিল সারা দেশের অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ের আর্তনাদ, তরুণ-তরুণীদের চোখে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ। সেই আর্তনাদে যে মুষ্টিমেয় কিছু তরুণ জীবন বাজি রেখেছিল, সেই আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায়ে আবির্ভূত হয় এক একটি নাম-যারা প্রতিবাদের মশাল হাতে শেষ পর্যন্ত জীবন বিলিয়ে দেন।
তাদের একজন ছিলেন যশোরের বেনাপোলের আব্দুল্লাহ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই ঢাকার রাস্তায় মাথায় গুলি খেয়ে ঢলে পড়েছিলেন এই ২৩ বছর বয়সী তরুণ। আজ তিনি নেই। রয়ে গেছে শুধু স্মৃতি আর কপালের মাঝখানে গুলির দাগে লেখা প্রতিরোধের অমর ইতিহাস।
শহীদ আব্দুল্লাহ ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়তেন ঢাকায় বড় বোনের বাসায় থেকে। গ্রামের বাড়ি যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানার সীমান্তবর্তী বড়আঁচড়া টার্মিনালপাড়ায়।
দিনমজুর বাবা আব্দুল জব্বার আর গৃহিণী মা মাবিয়া বেগমের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট, কিন্তু স্বপ্ন ছিল সবচেয়ে বড়। মেধা, বিনয় আর নেতৃত্বগুণে আব্দুল্লাহ পরিবার-পরিজনের ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। স্বপ্ন ছিল সবচেয়ে বড়- একদিন দেশের জন্য কিছু করে দেখাবেন।
কিন্তু সেই স্বপ্ন থেমে যায় রাজধানীর তাঁতীবাজার মোড়ে। ৫ আগস্ট দুপুর দুইটার দিকে শান্তিপূর্ণ মিছিলে ব্যানার হাতে দাঁড়ানো অবস্থায় তার কপালের মাঝখানে আঘাত হানে পুলিশের গুলি। পড়ে থাকেন রক্তাক্ত অবস্থায় দুই-তিন ঘণ্টা, সাহায্যের কোনো হাত কেউ বাড়িয়ে দেয়নি। পরে পথচারীদের সহায়তায় মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে।
সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে তার মাথা থেকে গুলি বের করা হয় বটে, কিন্তু অবস্থার জটিলতা কাটেনি। তবে এর মধ্যেই শুরু হয় আরেক ট্র্যাজেডির চিকিৎসা না-পাওয়ার লড়াই। ১০ আগস্ট তার অবস্থার অবনতি সত্তে্বও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে জোরপূর্বক ছাড়পত্র দেয়। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ফিরে আসেন বেনাপোলে। কিছুদিনের মধ্যে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। এরপর খুলনা মেডিকেলে, আবার ঢাকায় মেডিকেলে, শেষে সিএমএইচ-এ। এ চক্রে ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত হার মানে এই তরুণের জীবনের লড়াই।
২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর, সকাল আটটা। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) বিছানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আব্দুল্লাহ। যাকে নিয়ে পরিবার স্বপ্ন দেখেছিল একজন প্রশাসক, গবেষক বা শিক্ষক হবেন-তিনি এখন ইতিহাস। কিন্তু এই ইতিহাস গৌরবের, চোখ ভেজানো এক সাহসের প্রতিচ্ছবি।
আন্দোলনের সময় তার পাশে দাঁড়ানো বন্ধু শাওন হেসেন জানান, আব্দুল্লাহ ছিলেন সহজ-সরল, পড়ালেখায় মনোযোগী চিরসজাগ, সৎ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কণ্ঠস্বর। শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কখনোই বৃথা যায় না।
শহীদ আব্দুল্লাহর প্রতিবেশী ও আত্মীয় সেলিম রেজা বলেন, ‘তার মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের শোক নয়, বরং একটি দেশের বিবেকের প্রশ্ন। শহীদ আব্দুল্লাহ শুধু একটি নাম নয়-তিনি এখন হয়ে উঠেছেন প্রতিরোধের প্রতীক, ন্যায়ের ইতিহাসের ভূমিকা। রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকের রক্তের মূল্য দিতে ব্যর্থ, তখন এই তরুণেরা ইতিহাসের পাতায় নিজেদের রক্তেই লিখে যান-কীভাবে গণতন্ত্রকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়।’
তার আর এক প্রতিবেশী ভাবী শিল্পী খাতুন বলেন, ‘আব্দুল্লাহ আমাদের প্রতিবেশী ছিল। সে ছোট থেকে ছিল শান্ত, শিষ্ট ও ভদ্র। আমাদের চোখের সামনে মানুষ হয়েছে। অনেক অভাব-কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছে। এলাকার ছোট ভাইবোন, বড় ভাই, আত্মীয়স্বজনসহ সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করত। বন্ধুদের সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। সবার বিপদে এগিয়ে আসত। ঢাকা থেকে কলেজ ছুটিতে বাড়ি এসে পড়াশোনার পাশাপাশি আশেপাশের সবার খোজ নিত।’
শিল্পী আরও বলেন, ‘খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করে ঢাকায় গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। ইচ্ছা ছিল আর একটু পড়াশোনা করে একটা চাকুরি করে নিজের ও পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় ৫ আগস্ট দুপুরে কপালে গুলিবিদ্ধ হয় আব্দুল্লাহ। তিন মাস চিকিৎসার পর মৃত্যু ঘটে। ঘটনাটি অনেক কষ্টদায়ক।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেনাপোল পৌর কমিটির সদস্যসচিব সাজেদুর রহমান শিপু বলেন, ‘আব্দুল্লাহ আমার ক্লাসমেট। আমরা বেনাপোল হাইস্কুলের ২০১৭ এসএসসি ব্যাচের ছাত্র ছিলাম। সে একজন ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও বিলিয়েন্ট ছাত্র ছিল। ঢাকায় পড়াশোনা করত শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে। ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে ছোট খাট সহযোগিতা করা হয়েছে। আমরা সবসময় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তার জন্য সরকার যে ফান্ড দেবে তার বন্দোবস্ত করতে পেরেছি। বেনাপোল পৌর গেটটি তার নামে করার জন্য উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। সেটা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। আমাদের পক্ষ থেকে উপদেষ্ট মহলেও যোগাযোগ করছি।’
এই ছাত্রনেতা বলেন, ‘সরকারিভাবে তার পরিবারকে এককালীন ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সরকারি ভাবে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট দেয়া হবে যা প্রক্রিয়াধীন বলে জেনেছি। এ ব্যাপারে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে প্রয়োজনে সাংবাদিকদের ডেকে জানানো হবে।’
শহীদ আব্দুল্লাহর মা মাবিয়া বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলায় খুব ভয় পেত। আঁধার ঘর, হঠাৎ কোনো শব্দ সবকিছুতেই কেঁপে উঠত। কে জানত সেই ভয় পাওয়া ছেলেটাই একদিন দেশের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় দাঁড়াবে!’
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ঢাকা থেকে যখন বাড়ি আসত, দূর থেকেই ডাক দিত ‘মা মা বলে।’ এখনো সেই ডাক কানে বাজে কিন্তু সে আর ফেরে না।’
বাবা আব্দুল জব্বার বলেন, ‘শেষবার ফোনে বলেছিল, ‘আব্বু, শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় নাই, দেশ মুক্ত হয়ে গেছে। আমি ওর কণ্ঠে বিজয়ের উত্তেজনা টের পেয়েছিলাম, সেটিই ছিল আমাদের শেষ কথা।’
বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি তাকে ভালো শিক্ষা দিতে, সে ছিল পরিবারের গর্ব। সরকার কোথাও কোথাও শহীদ পরিবারকে সহায়তা দিচ্ছে শুনি, কিন্তু আমরা শুধু আশ্বাসই পাচ্ছি। আমাদের প্রতি রাষ্ট্রের যে সহানুভূতি থাকার কথা, তা এখনো পাইনি।’
শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ড. কাজী নাজিব হাসান বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ঢাকায় বিজয় মিছিলে যশোরের বেনাপোলের আব্দুল্লাহ নামের এক ছাত্র কপালে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হয়।’
তিনি বলেন, ‘শহীদ আব্দুল্লাহর পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবসময় সহযোগিতা করা হচ্ছে। সরকারি সব অনুষ্ঠানে তার পিতাকে সম্মানিত করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া জাতীয়ভাবে জুলাই-আগস্টে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা ও ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা রয়েছে বলে জানতে পেরেছি।’
ইউএনও আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে শহীদ আব্দুল্লাহর পরিবারকে সহায়তা করার জন্য তাদের পরিবারের ব্যাংক একাউন্ট নম্বর ও অন্যান্য তথ্য উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। দ্রুত তারা সরকারি এককালীন অনুদান ৩০ লাখ টাকা, ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ও মাসিক একটি ভাতা পাবেন।’
শহীদ আব্দুল্লাহর আত্মত্যাগ শুধু তার পরিবারের নয়, বেনাপোলবাসীর গর্ব। সেই গর্বকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে এলাকাবাসী ও তার পরিবার দাবি তুলেছেন বেনাপোল পৌরসভার প্রবেশদ্বারে থাকা প্রধান গেটটির নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ আব্দুল্লাহ গেট’ রাখার। যে গেট দিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি -বিদেশি মানুষ যাতায়াত করে থাকেন।
তারা চান, সেখানে যেন অমর হয়ে থাকেন শহীদ আব্দুল্লাহ। পাশাপাশি গেটটির পাশে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি তুলেছেন এলাকাবাসী, যাতে লেখা থাকবে একজন তরুণ কীভাবে মাথার রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখে গেছেন, কীভাবে ঢাকার রাজপথে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক নিপীড়িত তরুণ গড়েছেন স্বৈরাচারবিরোধিতার নতুন অধ্যায়।
এ দাবি কেবল একটি নামফলকের নয়, বরং এটি এক প্রজন্মের লড়াইকে স্মরণ রাখার, ইতিহাসকে সম্মান করার এবং রাষ্ট্রের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব পালনের বিষয়। শহীদ আব্দুল্লাহর নাম যেন গেটের ওপরে খোদাই হয়ে থেকে যায়- এ প্রত্যাশা এখন বেনাপোলের মানুষের।
আপনার মতামত লিখুন :