শতাধিক মামলার জালে ফেলে বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল আওয়ামী সরকার। একের পর এক হামলা চালানো হয়েছিল ঘরে। জামিন নিয়ে বের হলে নানা অজুহাত অভিযোগে ফের ঢুকানো হতো জেলে। রিমান্ডের নামে চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন। টানা ১৫ বছর নিপীড়নের সেসব যন্ত্রণার কথা বুকে চেঁপে নগরবাসীর নাগরিক সেবায় বছর কাটিয়ে দিলেন বিএনপির ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ নগরপিতা ডা. শাহাদাত হোসেন। রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠে সবাইকে আপন করে নিয়েছেন তিনি।
গত বছরের ৫ নভেম্বর সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর চট্টগ্রাম নগরীকে ক্লিন, গ্রিন এবং হেলদি সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে গত এক বছর প্রাণান্তর লড়াই করে যাচ্ছেন ডা. শাহাদাত। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) আর্থিক সক্ষমতা না থাকার পরও একের পর পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নগরবাসীর দরজায় নাগরিক সেবা পৌঁচ্ছে দেওয়ার মতো অসম্ভব চ্যালেঞ্জকে সম্ভব করেছেন শাহাদাত হোসেন।
আবর্জনার স্তূপে গলাসমান ডুবে থাকা শ্যাওলা পড়া এই নগরীকে স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ওয়াইফাই জোন করার জন্য ইতোমধ্যে গ্রামীণফোনের সাথে চুক্তি করেছে চসিক। ২৫ হাজার কোটি টাকার মনোরেল করার প্রকল্প এগ্রিমেন্ট হয়েছে কায়রোর একটা কোম্পানির সাথে। এ ছাড়াও বর্জ্য অপসারণে কোরিয়ান একটা কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে চসিকের। একইসঙ্গে ইউকে এবং নিউজিল্যান্ডের দুটি কোম্পানির সাথে বর্জ্য অপসারণ নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করছে চসিক। নগরীর ৪০ থেকে ৫০টা বড় সড়কের সংস্কারকাজে ইতোমধ্যে হাত দিয়েছে চসিক। সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন হলে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাটের আমুল পরিবর্তন আসবে মনে করছেন নগরবাসী।

গত এক বছরের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘সড়কবাতির জন্য এরইমধ্যে ১০টা টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। একইসাথে উড়াল সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মেয়র আসবে, মেয়র যাবে; নগরীর তদারকির দায়িত্ব নগরবাসীকেই নিতে হবে। এই নগর আমার-আপনার। এই নগরকে সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের সবারই।’
সাম্প্রতিক বর্ষায় চট্টগ্রামে নালায় পড়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ কমিয়ে আনতে সিডিএর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে সিটি করপোরেশন। জোয়ারের পানি যাতে নগরীতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য খালের মুখের রেগুলেটর পরিচালনাসহ নালা-খালগুলো পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এসবের সমন্বিত ফল চলতি বর্ষায় জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ কমে আসা। এবার আমরা ৬০ থেকে ৬২ শতাংশ সফল হয়েছি। আগামীতে এ দুর্ভোগ আরও কমে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জলাবদ্ধতার শতভাগ দুর্ভোগ কমাতে হলে নগরীর আরও ২১টি খাল সংস্কার করতে হবে। সেই খালগুলো সংস্কারের জন্য খালের ডিপিপি আমরা রেডি করছি। এই খালগুলো যদি সংস্কার করতে পারি তাহলে জলাবদ্ধতামুক্ত নগরী উপহার দিতে পারব।’
আলাপচারিতায় ডা. শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, ‘দালানকোঠায় ভরা এই নগরীতে শিশুদের জন্য খেলার মতো কোনো পরিবেশ নেই। দখল হতে হতে মাঠগুলো শূন্যের কোঠায়। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ৪১টি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটিতে অন্তত একটি করে মাঠ তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে ১১টি মাঠ প্রস্তুত করার কাজ চলছে। আশা করি, বাকিগুলো করে ফেলতে পারব।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন স্কুল-কলেজের যে মাঠগুলো সংস্কার করার দরকার ছিল সেই জায়গায় আমি হাত দিয়েছি। আরেকটি কাজ আমি বাংলাদেশে প্রথম করেছি, সেটি হচ্ছে স্কুল হেলথ কার্ড। বাচ্চারা ঘনঘন অসুস্থ হয়। তাদের নিয়মিত চেকআপ দরকার। আমি সে কাজটি করে দিয়েছি।’
ডা. শাহাদাত বলেন, ‘নগরীতে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ২০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এরমধ্যে ১ হাজার ৬০০ টন বর্জ্য অপসারণ করতে পারে চসিক। একবারও কি কেউ চিন্তা করেছেন বাকি ৮০০ টন বর্জ্য কোথায় যায়? এই ৮০০ টন বর্জ্য নালা ও খালে গিয়ে পড়ে। এ জন্য আমরা ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহ চালু করেছি। প্রাথমিকভাবে বেসরকারি কয়েকটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্জ্য নিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি। দেশে প্রথমবারের মতো বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে চসিক। চট্টগ্রাম কমার্শিয়াল সিটি, চট্টগ্রামকে সেভাবেই ভাবতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে চট্টগ্রাম বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। চট্টগ্রামকে হাঁটুপানির নিচে তলিয়ে রেখে কখনোই বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে বেশি সুবিধা যে প্রতিষ্ঠান ভোগ করে সেটি হলো বন্দর। অথচ সে বন্দর থেকে চসিক মাশুল পায় মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। ১৬২ কোটি টাকার মাশুল দেওয়ার কমিটমেন্ট করেছিল বন্দর। কিন্তু সে জায়গা থেকে তারা সরে গেছে। যে কারণে আমরা আবার জয়েন্ট সার্ভে শুরু করেছি।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের স্থাপনা আছে প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ বর্গফুটের কাছাকাছি। আগে ছিল এক কোটি ৫৪ লাখ। সে হিসাব করেই বন্দর ১৬২ কোটি মাশুল দেওয়ার কমিটমেন্ট করেছিল।’
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. শাহাদাত বলেন, ‘নগরীর মূল সড়কগুলো বারবার নষ্ট হয় বন্দরের ভারী গাড়ি চলাচলের কারণে। একেকটা লরি এবং ট্রাকের ওজন ৪০ থেকে ৫০ টন। অথচ নগরীর রাস্তাগুলো সাত থেকে আট টন যানবাহন চলাচল করার জন্য উপযোগী করে তৈরি করা। এই রাস্তায় যদি ৪০ থেকে ৫০ টনের ভারী গাড়ি চলে; রাস্তা তো নষ্ট হবেই।’
তিনি বিনয়ের সুরে বলেন, ‘এসব বিষয়গুলো বন্দরকে চিন্তা করতে হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গ্রেটিংয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রথম হয়েছে। তার মানে কাজ হচ্ছে। কিছু তো করতে পেরেছি। আমি মনে করি, এটা আমার কৃতিত্ব নয়, এটা চট্টগ্রামবাসীর কৃতিত্ব।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন