হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি রোডে বিবিয়ানা গ্যাস খোপের সামনে রাস্তার দক্ষিণ পাশে ভাড়া নেওয়া একটি অবৈধ কারখানায় পুরাতন ও বাতিল ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যাটারির প্লাস্টিকের কাভারগুলো দেশের বিভিন্ন ব্যাটারি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়।
প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার ব্যাটারি থেকে সিসা আলাদা করা হচ্ছে এ কারখানায়। ব্যাটারি পোড়ানোর ফলে সৃষ্টি হওয়া কালো ধোঁয়া ও অ্যাসিডের উৎকট গন্ধে পথচারীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র ছাড়াই পরিচালিত এই কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ফসলি জমি বেয়ে সরাসরি জোয়ালভাঙ্গার হাওর হয়ে কুশিয়ারা নদী গড়ে ওঠা খালের পানিতে মিশে যাচ্ছে। এতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে।
অবৈধ এই কারখানাটি জনগুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তায় প্রকাশ্যে পরিচালিত হলেও স্থানীয় প্রশাসনের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। এর পাশেই রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিবিয়ানা গ্যাস খোপ।
রায়পুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ও মিঠাপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘নবীগঞ্জ-আউশকান্দি আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে হবিগঞ্জসহ নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শত শত মানুষ প্রতিদিন সিলেটে যাতায়াত করে। কিন্তু রাস্তাসংলগ্ন ব্যাটারি কারখানা থেকে নির্গত অ্যাসিড ও সিসা পোড়ানোর ধোঁয়ায় তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।’
কারখানার পাশেই কুশিয়ারার খাল। এ কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য খালের পানির সঙ্গে মিশে জোয়ালভাঙ্গা হাওরের ফসলি জমিতে গিয়ে পড়ছে। এর ফলে আউশকান্দি চত্বরে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, পরিবেশ বিধ্বংসী এই কারখানাটি জনস্বার্থে অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কারখানার ভিতরে ব্যাটারি বোঝাই একটি ট্রাক ও কাভারভ্যান আনলোড করা হচ্ছে। এসব পুরাতন ব্যাটারি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছে।
শ্রমিকেরা পুরাতন ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে ভিতরের সিসা আলাদা করছেন। অ্যাসিড আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হলেও অবশিষ্ট অ্যাসিড মিশ্রিত পানি পাইপের মাধ্যমে সরাসরি হেদার খালের পানিতে ফেলা হচ্ছে।
প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ব্যাটারির পরিষ্কার করা প্লাস্টিক কাভার ট্রাকে লোড করে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন কারখানায়।
সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কারখানার ম্যানেজার মো. জিন্নাহ বলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করব। নিউজ করলে আমাদের ক্ষতি হয়ে যাবে।’
কারখানাটি ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে ১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করছেন। সবার হাতে প্লাস্টিকের গ্লাভস থাকলেও তারা নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
বগুড়া থেকে আসা দুই শ্রমিক মো. ওয়াজেদ ও হাসান বলেন, ‘শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগে ভুগছি, কিন্তু কাজ না থাকায় মাত্র ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে এই বিপজ্জনক কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি।’
তাদের মূল কাজ হচ্ছে ব্যাটারি কেটে সিসা গলানো। এই সিসা পুরাতন কাভারে ভরে নতুন ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া মোবাইল, ফ্রিজ, টিভি ও টিন তৈরিতেও সিসার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।
এ বিষয়ে কারখানার ম্যানেজার জিন্নাহ বলেন, ‘নবীগঞ্জ রোডের আউশকান্দি বিস্তীর্ণ এলাকা ফাঁকা পড়ে থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কারখানা স্থাপন করলে নানা অভিযোগ ওঠে। ফাঁকা এলাকায় সমস্যা কম হয় বলে এখানে কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে।’
এই সিসা কারখানার মালিক হচ্ছেন হবিগঞ্জ পৌরসভার রাজনগর এলাকার সাবেক কমিশনার রফিকুল বারী চৌধুরীর ছেলে এবং এনসিপি নেতা মাহবুবুল বারী চৌধুরী মুবিন। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ‘ব্যস্ত’ বলে এড়িয়ে যান। এরপর সংবাদ প্রকাশের বিষয়ে জানানো হলে সাংবাদিককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন।
এ বিষয়ে আউশকান্দি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘এসব অবৈধ কারখানা নবীগঞ্জের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর সরাসরি বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শুধু ব্যাটারি কারখানাই নয়, ইটভাটা ও মুরগির খামারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো জনবসতি এলাকায় স্থাপন করা আইনত নিষিদ্ধ।’
তারা অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় জনগণের মতামত উপেক্ষা করে পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কারখানা গড়ে উঠছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন অবৈধ প্রতিষ্ঠান যত্রতত্র স্থাপন হচ্ছে, যার ফলে রাস্তাঘাট ও প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে হবিগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. ইউসুফ আলী জানান, ‘সিসা তৈরির এই কারখানা সম্পর্কে আপনার কাছ থেকেই জানলাম। আমরা দ্রুত উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেব এবং আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’
নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. প্রত্যয় হাসেম বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জানা নেই। খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’