ঢাকা সোমবার, ২৬ মে, ২০২৫

শিগগির কাটছে না শিল্প খাতে গ্যাসের সংকট

স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৫, ০২:৩৪ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

দেশের শিল্পকারখানাগুলো গ্যাসের সংকটে ধুঁকছে। দৈনিক অন্তত ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার এমএমসিএফডি গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৫০ থেকে ১  হাজার ১০০ এমএমসিএফডি গ্যাস। যদিও জ্বালানি বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, বাড়তি আরও অন্তত ৭০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, তাতেও চাহিদার সিকিটুকুও মিটছে না। তাই ব্যবসায়ীরা এর স্থায়ী সমাধান চান। প্রয়োজনে অন্যান্য খাতে গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে হলেও শিল্পে গ্যাস সরবরাহের দাবি তাদের। তবে জ্বালানি বিভাগ দাবি করছে, শুধু শিল্প খাতের চাহিদা মেটাতে আরও ১ কার্গো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হয়েছে, যা দুই-এক দিনের মধ্যে আনলোড শুরু হবে। আর তখন সংকট অনেকটা কেটে যাবে। তবে এটিকে অবাস্তব পরিকল্পনা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশীয় কূপ খননে জোর দেওয়ার পাশাপাশি একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশে উৎপাদিত গ্যাস ও আমদানি করা গ্যাস বণ্টন করলে আপাতত এই সমস্যা থেকে বের হওয়া সম্ভব।
 
রূপালী বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, ভালুকা, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জসহ সব প্রধান শিল্পাঞ্চলেই কমে গেছে গ্যাসের সরবরাহ। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, সিরামিক, স্টিল খাতসহ বিভিন্ন শিল্পে। শিল্পমালিকেরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ শিল্পকারখানায়ই দিনে গ্যাসের চাপ থাকছে না। রাত ১১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ তুলনামূলক কিছুটা বেশি থাকলেও সব কারখানা ওই সময়টাতেই উৎপাদন কার্যক্রম বাড়িয়ে দেওয়ায় ফলাফল খুব ভালো হচ্ছে না। এ ছাড়া গ্যাসের চাপ না থাকার কারণে দিনের অন্য সময়টায় শ্রমিকদের অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। অনেক কারখানা শ্রমিক ছাঁটাইও করেছে। দিনভর যন্ত্রপাতি বন্ধ রেখে রাতের শিফটে উৎপাদন চালু রাখার কারণে ব্যয় বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিছু শিল্প সিএনজি, এলপিজি বা ডিজেল দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখার চেষ্টা করলেও সেটিও ব্যয়বহুল। এসব শিল্প চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছে না এবং গ্যাসের চাপ খুব কম। সিরামিক ও স্টিল শিল্পের উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ।

বিষয়টির সমাধানে রোববার (২৫ মে) সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে বৈঠক করেন ব্যবসায়ীরা। তাদের এক কার্গো এলএনজির পুরোটা সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছেন উপদেষ্টা। বৈঠকের বিষয়ে উপদেষ্টা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে এসেছিলেন তাদের সংকটের কথা তুলে ধরতে। গ্যাসের সংকট রয়েছে। এই সংকট কাটাতে আমরা আরও বাড়তি এলএনজি আমদানি করেছি। আশা করছি ২৮ তারিখের মধ্যে এটি আনলোড হয়ে সরবরাহ শুরু হয়ে যাবে। এতে করে কিছুটা হলেও সংকট কাটবে। তবে সংকটের পরিমাণ ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে তা দেখতে সোমবার (২৬ মে) থেকে আমরা কারখানাগুলো সরেজমিনে পরিদর্শনে যাব। তখন বুঝতে পারব প্রকৃত অবস্থা কী।
 
বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনার প্রকোপ কমতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে ধেয়ে আসে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকট সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে জ্বালানি ও খাদ্য খাতে। সারা বিশ্বে হু হু করে বাড়তে থাকে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। ঊর্ধ্বমূল্যে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে গিয়ে সরকারের তহবিল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তাতেও মিটছে না প্রয়োজনীয় চাহিদা। এতে করে রাজধানীসহ সারা দেশে তৈরি হয়েছে গ্যাসের তীব্র সংকট। আবাসিক খাতসহ পেট্রোল পাম্প, শিল্পকারখানাগুলোতে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত গ্যাসের চাপ। ফলে উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন এমনকি বাসা-বাড়িতে রান্নাবাড়ার কাজেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
 
সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পকারখানাগুলোতে গ্যাসের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। গ্যাসের প্রয়োজনীয় চাপ না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। নিজের কারখানায় গ্যাসের প্রেশার প্রায় দিনই জিরো থাকে জানিয়ে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শিল্প খাতে ২৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস বাড়ানোর কথা দিয়েছিল। কিন্তু সেটা দূরে থাক, আমরা নিয়মিতভাবে যে গ্যাস পেতাম, সেটিই পাচ্ছি না। আমার নিজের কারখানারই অনেক শিপমেন্ট বাতিল করতে হয়েছে। অনেকগুলো আবার দেরিতে উৎপাদন হওয়ায় শিপমেন্টের তারিখ বদলাতে হয়েছে। এতে করে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এই ক্ষতি আমরা কী দিয়ে পোষাব? আমার জানামতে, কয়েকটি কারখানায় জরুরি কাজ ফার্নেস ওয়েল কিনে করছে। কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে? 

গাজীপুরের একটি নিটিং কারখানার পরিচালক জানান, তারা দৈনিক প্রায় ৭০ টন সুতা উৎপাদন করতেন। বর্তমানে করছেন ১২-১৩ টন। ১০ পিএসআই চাপে গ্যাস পাওয়ার কথা। কিন্তু গত দুই বছর ধরে পাচ্ছেন ২ থেকে ৪ পিএসআই। ফলে দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদন কমে গেছে।

সাভার ও আশুলিয়ায় ১ হাজার ২০০-এর বেশি কারখানা রয়েছে। তিতাসের গ্যাস সরবরাহ যথেষ্ট না হওয়ায় কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে এসেছে ১ থেকে ৩ পিএসআইয়ে। অথচ প্রয়োজন ১৫ পিএসআই। ফলে জেনারেটর চালু করা যাচ্ছে না, বয়লার গরম করা যাচ্ছে না। এমনকি প্রায় সময় ড্রায়ার মেশিন বন্ধ থাকায় সময়মতো তৈরি পোশাক ওয়াশও করা যাচ্ছে না।
  
পেট্রোবাংলা ও শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ১০৪ কোটি ঘনফুট ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে, সাড়ে ১২ কোটি সার কারখানায়। শিল্প ও আবাসিকে যায় ১৫১ কোটি ঘনফুট গ্যাস। জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৮৮ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস। চার বছর আগেও এই পরিমাণ ছিল ২৪৭ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ, দেশীয় উৎপাদন কমেছে প্রায় ৫৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস। সরবরাহ মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে হলে আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। দেশে দৈনিক ১১০ কোটি ঘনফুট এলএনজি গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ, দেশীয় উৎস ও আমদানি মিলিয়ে বর্তমানে দৈনিক গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা কমে গিয়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটেরও কম।

তবে আমদানির প্রবণতা থেকে বেরিয়ে দেশীয় কূপগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এলএনজি আমদানির নামে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার লুটপাটের মহোৎসব করেছে। এই সরকারও যদি সংকট সমাধানের উপায় হিসেবে আমদানির পথই বেছে নেয়, তাহলে তো কোনো পার্থক্য থাকল না। আমাদের দেশীয় কূপগুলো খননে জোর দেওয়া উচিত এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি।