২০২৪ সালের জুলাই মাস ছিল না শুধু একটি ক্যালেন্ডার-নির্ধারিত ৩১ দিনের সময়কাল বরং তা ইতিহাসে পরিণত হয়েছিল ৩৬ দিনের দীর্ঘ এক সংগ্রামে। এই ‘৩৬ জুলাই’ এখন কেবল একটি প্রতীকী পরিভাষা নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের অন্যতম যুগান্তকারী এক অধ্যায়।
এই আন্দোলনের সূচনা হয় ৫ জুন, হাইকোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে। সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয় প্রতিবাদ, যা দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
১ জুলাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিন, আন্দোলন ফিরে আসে দ্বিগুণ শক্তিতে। শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করে, যা খুব দ্রুতই গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
৪ জুলাই, হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকায়, ৬ জুলাই থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ শুরু হয়। সারাদেশে সড়ক ও রেলপথে অবরোধ, অচল হয়ে পড়ে জনজীবন। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে, কিন্তু আন্দোলনের ধারা কমে না; বরং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিতর্কিত বক্তব্য ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কেউ মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারাই মেধাবী’ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনে আগুন ছড়িয়ে দেয়।
১৫ ও ১৬ জুলাই ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর ও রংপুরে ছাত্রলীগের হামলা এবং পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত করা হয়। শহীদ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ। আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তখন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
১৭-১৮ জুলাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হন, ঢাকায় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির আওতায় অন্তত ২৯ জন নিহত হন। সরকারপ্রধান প্রস্তাব দেন ২০ শতাংশ কোটা রাখার, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
১৯ জুলাই ছিল ভয়াবহতম দিন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুলি, গ্রেপ্তার, লাশের স্তূপ অচেনা রূপে দেখা দেয় দেশ। সেনা মোতায়েন ও কারফিউ দিয়েও দমন করা যায়নি আন্দোলন। বরং ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ সর্বস্তরের মানুষ এতে যুক্ত হন।
৩১ জুলাই পেরিয়ে ১, ২, ৩ আগস্টও বিক্ষোভ চলতে থাকে। ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা দাবি এবং ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি নির্ধারিত হয়। সেদিন দুপুরের আগেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে ভারত পালিয়ে যান। জনতার দীর্ঘ ৩৬ দিনের বিজয়ের দিন হিসেবেই ৫ আগস্ট চিহ্নিত হয় ‘৩৬ জুলাই’ নামে।
এই আন্দোলন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয় এটি একটি প্রজন্মের আত্মজাগরণ। যে প্রজন্ম রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তারা বুঝে যায় রাজনীতি থেকে দূরে থেকে নয়, রাজনীতিকে বদলেই বাঁচতে হবে। সেখান থেকেই জন্ম নেয় এই বিপ্লব একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে দীপ্ত, এক ‘৩৬ দিনের’ দীর্ঘ জুলাই।
আপনার মতামত লিখুন :