ঢাকা শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫

ডিজিটালেও বন্ধ হয়নি ঘুষ-অনিয়ম

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৫, ১২:১৪ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের যেকোনো জায়গায় যৌথ ব্যবসা বা এককভাবে বড় কোনো ব্যবসা করতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের (আরজেএসসি) সনদ বাধ্যতামূলক। প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নিতে হলে অনলাইনে আবেদন করতে হয়, সশরীরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডিজিটাল যুগেও জয়েন্ট স্টক নামে পরিচিত এই অফিসে এখনো এনালগ যুগের মতোই ভোগান্তি পোহাতে হয় সেবাগ্রহীতাদের। নতুন কোনো কোম্পানির নামের ছাড়পত্র ও নিবন্ধন সনদ নিতে ঘাটে ঘাটে দিতে হচ্ছে ঘুষ।

আরজেএসসি হলো বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র অফিস, যা দেশের আইন অনুযায়ী কোম্পানি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গঠনের সুবিধা দেয় এবং এর মালিকানা সম্পর্কিত সব নথিপত্র সংরক্ষণ করে। এই পরিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনে।

এই নিবন্ধনসেবা কার্যক্রম বেশ কয়েক বছর অনলাইনে শুরু করা হলেও তার সুফল মেলেনি আজও। ডিজিটাল কারসাজির মাধ্যমে ঘুষ আদায় করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন উদ্যোক্তা ও আইনজীবী। অভিযোগ আছে পুরোনো কোম্পানির নিবন্ধন নবায়নেও ভোগান্তিতে পড়ার। 

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নতুন কোম্পানি খুলতে বা পুরোনো কোম্পানির নিবন্ধন নবায়ন করতে অনেকেই আর এই অফিসে যেতে চান না। প্রয়োজন মেটাচ্ছেন আইনজীবীদের মাধ্যমে।

অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরজেএসসির নিবন্ধক (অতিরিক্ত সচিব) এ কে এম নূর নবী কবীর। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন আর ভোগান্তির কোনো সুযোগ নেই। কারণ এখন পুরোপুরি অনলাইননির্ভর সেবা দেওয়া হয়। কাউকেই সশরীরে আসতে হয় না। একটা অনলাইন সিস্টেমে যা যা থাকা দরকার, তা তাদের ওয়েবসাইটে সবই আছে।

নিজের ব্যবসা শুরু করতে সনদ নিতে আরজেএসসিতে যান আবদুর রহিম (ছদ্মনাম) নামে এক ব্যক্তি। সনদ নেওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, তার নতুন কোম্পানির সনদ নিতে প্রথমে একাই জয়েন্ট স্টকে যান। তারা তাকে অনলাইনে আবেদন করতে বলেন। তাদের কথামতো তাদের সাইটে ঢুকে নামের ছাড়পত্র নিতে গিয়ে দেখেন, প্রথমেই তার ইউজার আইডি চাইছে। 

এখন নতুন মানুষ হিসেবে বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে ইউজার আইডি দিতে হয়? পরে আরেকজনের সাহায্য নিয়ে নামের ছাড়পত্র নেন। এরপর নিবন্ধন সনদ নিতে গিয়ে দেখেন, অসংখ্য তথ্যের ঘর পূরণ করতে হবে। কষ্ট করে তারা যা যা চায় সেটাও পূরণ করেন। টাকাও জমা দেন। কিন্তু পরে তার সনদের আর কোনো হদিসই পান না।

তিনি বলেন, পরে এক আইনজীবীর কাছ থেকে জানতে পারেন অনলাইনে ফরম পূরণের ২১ দিনের মধ্যে সনদ পেয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো ভুল তথ্য দিলে সেটা ২১ দিন পর আপনা-আপনি বাতিল হয়ে যাবে। তারটাও বাতিল হয়ে গেছে। এই ভুলের জন্য পরে আইনজীবীর মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পুনরায় আবেদন করে সনদ পেয়েছেন।

আবদুর রহিমের জিজ্ঞাসা, অনলাইনে ফরম পূরণ করলে তার ভুল ধরিয়ে দেবে কে? একজন নতুন মানুষ কীভাবে বুঝবে কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক।

আরজেএসসিতে বিভিন্ন কোম্পানির সনদ নিতে সাহায্য করেন এমন এক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনলাইনে সনদ নেওয়ার এমন একটা প্রক্রিয়া এখানে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে নতুন কোনো সাধারণ মানুষ এটা না করতে পারেন। করলেও সবাই যেন ভুল করে, এটা তাদের জানা। 

সবাই যেন আমাদের মতো আইনজীবীর মাধ্যমে করে সেই ব্যবস্থাই করা আছে। কারণ আইনজীবীরা সবাই কর্মকর্তাদের পরিচিত, তাই তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। তারাও রুটি-রুজির জন্য কর্মকর্তাদের নিয়মিত ঘুষ দিয়ে কাজ করছেন।

তিনি বলেন, অনলাইনে কোনো ভুল তথ্য রেকর্ড করা হলে তা সংশোধনের জন্য আবেদনকারীদের জানানোর কথা থাকলেও কর্মকর্তারা সেটা জানান না। তাই তারা বাধ্য হয়ে নিজেরাই ২১ দিনের মধ্যে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তখনই শুরু হয় ঘুষ লেনদেনের ঘটনা। কারণ ২১ দিনের মধ্যেই ভুল সংশোধন করে সনদ পেতে হবে। 

ওই সংশোধন না করলে সনদ তো মিলবেই না, জমা দেওয়া অর্থও ফেরত পাওয়া যাবে না। আর এই সুযোগটাই নেন অসাধু কর্মকর্তারা। তা ছাড়া সব সঠিক তথ্য দিলেও লাভ হয় না। ওখানকার সিন্ডিকেট টালবাহানা করতে থাকে। ফরমে সঠিক তথ্য থাকলেও তথ্যের ঘাটতি বা ভুল দেখায়। এসব অজুহাত দেখিয়ে ঘুষ দাবি করে আবেদনকারীর কাছে। না দিলে অনলাইনে এই সনদ আর পাওয়া যায় না।

এই আইনজীবী জানান, এখানে নতুন কোম্পানির সনদ নিতে আসা ব্যক্তিদের দুই ধরনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। প্রথমে ঘুষ দিতে হয় অথরিটি কর্মকর্তাকে, যিনি কোম্পানির নামের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে থাকেন। 

আরজেএসসিতে এই রকম কর্মকর্তা সবাই কমবেশি টাকার বিনিময়ে সনদ যাচাই-বাছাই করে থাকেন। টাকা না দিলে সনদ পাওয়া যায় না। এরা সবাই উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত। সাধারণ মানুষ সনদ নিতে গেলে এদের দুই-আড়াই হাজার টাকা দেওয়া লাগবেই। আর আইনজীবীরা গেলে এক হাজার টাকা দিলেই হয়।

এই আইনজীবী তথ্য অনুযায়ী, এই অথরিটি কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাইয়ের পর ফাইল যায় সহকারী নিবন্ধকদের কাছে। তারাও টাকা ছাড়া ফাইল ছাড়েন না। সাধারণ মানুষ এই সনদ নিতে গেলে সহকারী নিবন্ধককে দিতে হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। আর তাদের দিতে হয় দুই হাজার টাকা। 

সব মিলিয়ে একজন সাধারণ মানুষ সনদ নিতে গেলে তাকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হবে। আর তাদের মতো আইনজীবী দিয়ে সনদ নিতে গেলেও দুই থেকে তিন হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।

তিনি জানান, পুরোনো কোম্পানির নিবন্ধন নবায়ন, মালিকানা পরিবর্তনসহ নানা ধরনের ছাড়পত্রের জন্য যেতে হয় সহকারী নিবন্ধকের চেয়ে বড় কর্মকর্তাদের কাছে। এসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেশি ঘুষ আদায় করেন বার্ষিক রিটার্ন ফাইলিং, কোম্পানির পরিচালক পরিবর্তনসহ সংশ্লিষ্ট সব নথির অবিকল নকল কপি সরবরাহসহ নানা ধরনের সেবার ছাড়পত্র দেওয়ার নামে। মূলত নতুন কোম্পানি খোলার নিবন্ধন বা পুরোনো কোম্পানির নিবন্ধন নবায়নসহ এসব কাজ ঘুষ ছাড়া করা যায় না। এটাই এখানকার নিয়মে পরিণত হয়েছে।

আরজেএসসিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাব আছে, যার কারণে অনেক কর্মকর্তাই সময়মতো কাজ করেন না। পাবলিক রিলেশনেরও অভাব আছে এই অফিসে। সাধারণ মানুষ জানে না এই অফিসে কীভাবে কী করতে হয়। কর্তৃপক্ষ এগুলোর সমাধান করতে পারলে সাধারণ মানুষও উপকৃত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।