ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২২ মে, ২০২৫

এত দাবির শেষ কোথায়?

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: মে ২২, ২০২৫, ০৬:১৫ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

স্নাতক (পাস) ২০২২ সালের ফেল করা একদল শিক্ষার্থী অটোপাসের দাবিতে গতকাল বুধবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাস ঘেরাও করে। এ সময় ক্যাম্পাসে আসা বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক এএসএম আমানুল্লাহ প্রশাসনিক ভবনের গেটে তার গাড়ি থেকে নামতেই তাকে ঘেরাও করে স্লোগান দিতে থাকেন ওই শিক্ষার্থীরা। এখানেই তারা ক্ষান্ত হননি। অটোপাসের দাবিতে উপাচার্যের ওপর হামলাও করেন। এতে আহত হয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ শাখা বলছে, করোনা মহামারি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বিবেচনা করে এই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের এরইমধ্যে গ্রেস মার্ক দিয়ে পাস করানো হয়েছে। পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া তাদের খাতা পুনর্মূল্যায়নের সুযোগও দেওয়া হয়েছে, যার ফল এ মাসেই বের হবে। কিন্তু বিভিন্ন মহলের উসকানির পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাচের কিছু অকৃতকার্য শিক্ষার্থী আবার অটোপাসের দাবি নিয়ে এসে এই হামলা চালিয়েছে। 

শুধুই এ দাবি নয়, গতকাল জাতীয়করণের দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি থেকে সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ করেন এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। এ সময় শিক্ষকদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষও হয়। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। শিক্ষকদের এই আন্দোলনের কারণে দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক। এ ছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে শপথ পাড়ানোর দাবিতে ছয় দিন ধরে নগর ভবন অবরুদ্ধ করে অবস্থান কর্মসূচির পর গতকাল রাজধানীর মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট এলাকা, কাকরাইল ও যমুনার দিকের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তার সমর্থকরা। এতে দিনভর অচল ছিল ওই সড়ক। শুধু এই তিন আন্দোলনই নয় গতকাল রাজধানীর অন্তত ৭টি জায়গায় নানা দাবি নিয়ে রাস্তায় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সামনে অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনকারীরা। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই নানা বৈষম্যের ও হয়রানির শিকার হয়েছেন জানিয়ে রাজধানীতে আন্দোলন করছেন ভুক্তভোগীরা। এসব দাবি আদায়ে প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন তারা। ফলে রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছে আন্দোলনের নগরীতে। দাবি আদায়ে পেশাজীবীদের মধ্যে একদিকে যেমন উৎসাহও বেড়েছে, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে বাড়ছে অস্বস্তি। শুধু সরকার নয়, দাবি-দাওয়া নিয়ে বিরক্ত রাজধানীর সাধারণ মানুষ। সড়ক বন্ধ করে সভা-সমাবেশে নানা বিধিনিষেধ থাকলেও কেউ তা মানছেন না। দাবি আদায়ে প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক বন্ধ করে, অবস্থান অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। সবার মুখে একই প্রশ্ন, এসব দাবির শেষ কোথায়? তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারকে বোঝাতে হবে এই সরকার অন্তর্বর্তীকালীন বা সংকটকালীন সরকার। দাবি পূরণ করা তাদের কাজ নয়। দাবি পূরণ করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার। তাহলেই এই সংকট দূর হয়ে যাবে। দেশের বিশেষ প্রেক্ষাপটে গঠিত সংকটকালীন সরকারের কাছে এত দাবি আসাটাও স্বাভাবিক নয়। তাই এগুলোর পেছনে কোনো মহলের ইন্ধন থাকতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীতে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে অন্তত ৩০০ আন্দোলন হয়েছে। চাকরি স্থায়ীকরণ, সরকারিকরণ, বদলি-নিয়োগ, অটোপাস ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা ইস্যুতে হয়েছে আন্দোলন। এমএলএসএস থেকে শুরু করে ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও করেছেন আন্দোলন। কোনো কোনো আন্দোলনের তেজ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশেও। কোনো কোনো আন্দোলন সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে সরকারকে। আবার আন্দোলন করে বিগত সরকারের আমলের সুবিধাভোগীরাও ভোল পাল্টে বসেছেন বিভিন্ন ক্ষমতাসীন জায়গায়। মাঝখানে এসব দাবি-দাওয়া কিছুটা কমে আসলেও সম্প্রতি তা আবার বৃদ্ধি পেয়েছে।

সরকার সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আন্দোলন করলেই সরকার দাবি মেনে নেয়, এমন ধারণা থেকেই দাবি আদায়ের মিছিল বাড়ছে। তবে কোনো কোনো আন্দোলনের পেছনে রয়েছে সরকারবিরোধী শক্তির ইন্ধনও। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অনেক তুচ্ছ ঘটনাকে বড় ইস্যু বানিয়ে আন্দোলনে নামছে একটি পক্ষ। এসব দাবি-দাওয়া সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় সরকারকে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক সচিব বলেন, এত দাবি-দাওয়ার ভিড়ে ঠিকমতো দাপ্তরিক কাজও করা যাচ্ছে না। দাবি সামাল দিব, না কাজ করব। 

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রথমদিকে আন্দোলনকারীরা নানা দাবি নিয়ে জড়ো হতেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন) সামনে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের আরেকটি ‘পছন্দের’ জায়গা হয়ে ওঠে শাহবাগ। নিষেধাজ্ঞার কারণে যমুনার সামনে এখন কেউ কর্মসূচি পালন করতে না পারায় শাহবাগের ওপর ‘চাপ’ বেড়েছে। এ ছাড়াও প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিদিনই কমপক্ষে ৬-৭টি সভা-সমাবেশ আর বিক্ষোভ আছেই। 

বিক্ষোভ-সমাবেশে বিরক্ত মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নাহিদুল ইসলাম। তিনি মতিঝিলে একটি প্রাইভেট ফার্মে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত। নাহিদুল বলেন, প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে দেখি পরেরদিন কী আন্দোলন আছে। এই আন্দোলনে যানজটের যন্ত্রণায় কাজ করাই মুসকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বিশ্লেষকরা যা বলছেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারকে বোঝাতে হবে এটা একটি সংকটকালীন সরকার। সংকট পূরণের সংশ্লিষ্ট কাজগুলোই তারা করছেন। দাবি পূরণ করার জন্য তারা আসেননি। দাবি পূরণের কাজ করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার। এ ছাড়াও এই দাবি-দাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে পূরণ হলেও পরবর্তী নির্বাচিত সরকার তা নাও মানতে পারে এটা জনগণকে বোঝাতে হবে। যদি পরবর্তী সরকার না মানে তাহলে সমাধান হওয়া বিষয়গুলো কার্যকর নাও হতে পারে। 

তিনি বলেন, সরকার এসব বিষয়গুলো জনগণকে বুঝতে দিচ্ছে না। তারা বোঝাতে চাচ্ছে এটি একটি নিয়মিত সরকার। তারা জনগণকে মেসেজ দিয়েছে তারাও এসব দাবি-দাওয়া পূরণ করতে পারেন। ফলে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। সরকার যদি তাদের আচার-আচরণে সংকটকালীন দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন এটা বোঝাতে পারলেই এসব সমস্যা সমাধান হবে।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যৌক্তিক দাবি নিয়ে মানুষের যেমন সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষেরও তার চলাচলের স্বাধীনতা আছে। তবে নিয়ম হচ্ছে যেখানে সমাবেশ করা যায় সেখানেই সমাবেশ করবেন। মানুষের প্রতিবন্ধকতা হয় এমন জায়গায় সমাবেশ করার আইনসিদ্ধ নয়। এটা নাগরিক অধিকারের পরপন্থি। 
 
তিনি বলেন, রাস্তা ব্লক করে দিলে একটা চাপ তৈরি হবে, সংশ্লিষ্টরা দাবি মেনে নিবেন, এটা অনেকেরই ধারণা। কিন্তু সরকারকে স্পষ্ট করা উচিত রাস্তা বন্ধ করে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করলে আমরা বিচেনায় নিব না। এই বার্তা দিতে পারলে সংকট কিছুটা দূর হবে।