কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার ৫০ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনিয়ম ও চিকিৎসক সংকট যেন নৈমিত্তিক ঘটনা। রোগীরা অফিস সময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে বিস্তর অভিযোগ। ভেড়ামারা উপজেলার প্রায় তিন লক্ষাধিক জনগণ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দৌলতপুর ও মিরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের লোকজন এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন। তাছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী অধিকাংশ সময়ে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা নেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, হাসপাতালটিতে ২৫ জনের বিপরীতে মাত্র চার-পাঁচজন চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বেশির ভাগ চিকিৎসক প্রেষণে অথবা উচ্চতর প্রশিক্ষণে রয়েছেন। ফলে চিকিৎসাসেবায় বিঘ্ন ঘটছে। তাই কখনো কখনো ডাক্তারদের ১৮ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করা লাগে। এতে চিকিৎসকদেরও শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে স্থানীয় ও প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য। তবে যে কজন ডাক্তার রয়েছেন, তাদের মধ্যেও দু-একজন কুষ্টিয়া জেলা সদরে অবস্থান করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনমতো জনবল না থাকার পরও ডাক্তারদের অনিয়ম ও অবহেলার কারণে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না এমনই অভিযোগ সাধারণ রোগীদের। দৈনিক ওষুধ সরবরাহের তালিকায় রোগীদের ওষুধ দেওয়ার বিধান থাকলেও তেমন কোনো ওষুধই দেওয়া হয় না।
প্রতিদিনই হাসপাতালে বরাদ্দকৃত সিটের বাইরে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তাই তাদের ফ্লোরে অথবা বারান্দায় বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। তবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরেজমিনে ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে রোগী সিটে থাকলেও অধিকাংশ ডাক্তার, নার্স ও স্টাফরা ছিলেন অনুপস্থিত। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসতে থাকেন ডাক্তার, নার্স ও স্টাফরা। হাসপাতালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষমাণ চার-পাঁচ মাসের শিশুদের কোলে নিয়ে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার আসায় বসে আছেন মায়েরা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এখানে একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো-সার্জারি) ও তিনজন মেডিকেল অফিসার থাকলেও জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া) জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন) পদ খালি রয়েছে।
তিনজন মেডিকেল অফিসার পদে কর্মরত দেখালেও মেডিকেল অফিসার ডাক্তার পলাশ চন্দ্র দেবনাথ (কোড নম্বর- ১৩১৯০০) গত ০২/০২/২০২৩ তারিখ থেকে ০৫/০২/২০২৩ তারিখ পর্যন্ত নৈমিত্তিক ছুটি অনুমোদন করে ০৬/০২/২০২৩ তারিখ থেকে অনুমোদিতভাবে অনুপস্থিত রয়েছেন। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন।
এছাড়াও আইএমও, এনেসথেটিষ্ট ও এমও-এর পদ খালি রয়েছে। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে একজন করে মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও সবগুলোই পদ শূন্য। শুধুমাত্র সাতবাড়ীয়া উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিয়োগকৃত মেডিকেল অফিসারকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে।
একজন মিডওয়াইফ, একজন জুনিয়র নার্স, একজন অ্যাকাউনটেন্ট, একজন ক্যাশিয়ার, তিনজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই), দুজন স্বাস্থ্য পরিদর্শক, ১২ জন স্বাস্থ্য সহকারী, একজন কম্পাউন্ডার, অফিস সহায়ক, তিনজন ওয়ার্ড বয়, দুজন আয়া, দুজন কুক, একজন মালিক, একজন নিরাপত্তা প্রহরী, তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের দুজন অফিস সহায়ক এর পথ শূন্য রয়েছে।
সংকট রয়েছে ওষুধেরও। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের আঙিনা অত্যন্ত নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। হাসপাতলে কোনো রোগীর সাথে কেউ আসলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তিনিও যেন অসুস্থ হয়ে যান।
এছাড়া রয়েছে আঞ্চলিকতার প্রভাব। এছাড়া হাসপাতালে শিডিউল অনুসারে রোগীদের খাবার দেওয়া হয় না। এসময় ভুক্তভোগী রোগী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপকালে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরেন তারা। হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলা বাহাদুরপুর গ্ৰামের আসাদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমার সন্তান শিশুকে নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছি। কোনো ওষুধ পাচ্ছি না। হাসপাতালে খাবার-দাবারের মানও ভালো না। চিকিৎসকরা ঠিক মতো আসেন না রোগীর কাছে। নার্স ও আয়ারাও ভালো ব্যবহার করেন না।
প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী না থাকায় প্রায়ই ঘটছে চুরির ঘটনা। ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান অভিযোগের কিছুটা স্বীকার করে বলেন, হাসপাতালে ব্যাপক জনবল সংকট রয়েছে। একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কার্যালয়ে আবেদন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত কমসংখ্যক জনবল দিয়েও এই বিশাল এলাকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালের অনিয়মের বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। আমি ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে পরিদর্শন করেছি। তবে, হাসপাতালে জনবল ও চিকিৎসক সংকট প্রকট রয়েছে। এছাড়া অফিস টাইমে বাইরে চিকিৎসকরা রোগী দেখার বিষয়টি আমার জানা মতে সঠিক নয়। কারণ, ডাক্তারই হাতেগোনা কয়েকজন, তারা আবার চেম্বার করেন কখন! এছাড়া স্টাফদের অনিয়ম ও দুর্ব্যবহারের বিষয়টি খতিয়ে দেখব।

