পাবনার ঈশ্বরদীতে রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এ বছরই উৎপাদনে আসছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পটির প্রথম ইউনিট থেকে শিগগিরই জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। পূর্ণভাবে চালু হলে কেন্দ্রটি ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে, যা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন কেবল সরবরাহই বাড়াবে না, বরং বিদ্যুৎ আমদানিতে কমিয়ে আনবে ভারতনির্ভরতা।
বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রূপপুর উৎপাদনে এলে বিদ্যুৎ আমদানিতে ভারতের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। বর্তমানে ভারতের আদানি পাওয়ার ও জিটুজি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ মোট ২,৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে, যা জাতীয় চাহিদার প্রায় ১৭ শতাংশ। তবে রূপপুরের পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে এই নির্ভরতা প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে থাকা অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যয়বহুল ফার্নেস অয়েল বা ডিজেলভিত্তিক হওয়ায় সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিপুল অর্থ খরচ হয়। এই পরিস্থিতিতে কম খরচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে ওই অঞ্চলে ভারতের বিদ্যুৎ আমদানির ওপর বেশি নির্ভরতা রয়েছে।
রূপপুর কেন্দ্র চালু হলে উত্তরাঞ্চলে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে সেই বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে রূপপুর থেকে বগুড়া, গোপালগঞ্জ, কালিয়াকৈর ও বাঘাবাড়ী পর্যন্ত ৪টি ৪০০ কেভির উচ্চক্ষমতার সঞ্চালন লাইন নির্মিত হয়েছে এবং সফলভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে জাতীয় গ্রিডে।
বিপিডিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, রূপপুরের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে ভারতের আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানির বিকল্প তৈরি হবে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা বিতর্কিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির কারণে বর্তমানে বিপিডিবিকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে, এমনকি বড় অঙ্কের বকেয়া পরিশোধ না করায় মাঝেমধ্যে সরবরাহ বন্ধ থাকছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি নিয়ে রয়েছে বড় ধরনের বিতর্ক। বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা, এমনকি কয়লার দাম নিয়ে দীর্ঘদিনের জটিলতা থাকলেও কোনো সমাধানে যেতে পারেনি বিপিডিবি।
উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে আদানির বিকল্প না থাকার কারণেই মূলত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না বলে বিপিডিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান। এখন রূপপুর উৎপাদনে এলে এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সে বিদ্যুৎ উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করা গেলে আমদানি বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমবে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। প্রায়োরিটির ভিত্তিতে রূপপুর-বগুড়া ও রূপপুর-গোপালগঞ্জে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে অনেক বেশি। ফলে সে বিদ্যুৎ ওদিকে সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে বিপিডিবির। আমরা রূপপুরের বিদ্যুৎ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে মোট চারটি গ্রিড লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো হলো- রূপপুর-বগুড়া, রূপপুর-গোপালগঞ্জ, রূপপুর-কালিয়াকৈর ও রূপপুর-বাঘাবাড়ী। ৪০০ কেভি এসব উচ্চক্ষমতার সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে তা সফলভাবে সংযুক্তও করা হয়েছে। কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলে এসব লাইনে দেশের উত্তরাঞ্চলে বড় আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।
এনপিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাসান জানান, রূপপুরের প্রথম ইউনিট এ বছরই উৎপাদনে আসার লক্ষ্যে কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ৩৬৩ জন প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত করা হয়েছে এবং ইউনিট-১ এ ফিজিক্যাল স্টার্টআপ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বর্তমানে ফুয়েল লোডিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, রূপপুর চালু হলে ব্যয়বহুল জ্বালানি তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাবে, যার ফলে উৎপাদন খরচও হ্রাস পাবে। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
তবে এখনো রূপপুর ও বিপিডিবির মধ্যে কোনো বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয়মূল্য ঠিক না হওয়ায় এ বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৪২৪ মেগাওয়াট। রূপপুরের প্রথম ইউনিট চালু হলে তা বেড়ে যাবে প্রায় ২৮ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটে। ফলে দেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর অতিনির্ভরতা কমবে এবং বিদ্যুৎ খাতে নতুন ভারসাম্য তৈরি হবে।
আপনার মতামত লিখুন :