ঢাকা শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ঋণের বোঝায় ট্রেনের নিচে মিঠুন দাস, বিপাকে পরিবার

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫, ০৭:৪৬ পিএম
ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করা রাজশাহী চারঘাট বনকিশোর গ্রামের মিঠুন দাসের মা শ্রীমতি রানী ও স্ত্রী বিউটি দাস। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

অনেক টাকা ঋণ করেছেন, তাই যা আয় করতেন তার সবই চলে যেত ঋণ শোধে। বোঝা টানতে না পেরে শেষমেষ ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী চারঘাট বনকিশোর গ্রামের মিঠুন দাস (২৮)। আত্মহত্যায় এখন বিপাকে পড়েছে তার পরিবার—কীভাবে ঋণের টাকা শোধ করবেন তা নিয়ে হতাশায় পড়েছে পরিবারটি।

গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ফেসবুকে লাইভে এসে দুঃখের কথাগুলো বলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ হারান মিঠুন।

মিঠুনের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামে। বাবার নাম প্রেমানন্দ দাস। ১৪ মাস আগে নাটোরের মেয়ে বিউটি দাসের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মিঠুনের।

মিঠুন দীর্ঘদিন ধরেই থাকতেন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর এলাকায়। সেখানে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দেওয়ার ব্যবসা করতেন। তিন মাস আগে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে ১০ হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরিও নিয়েছিলেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, কোম্পানির চাকরি করা অবস্থায় মিঠুন দাসের ব্যাগ থেকে চুরি হয়ে যায় কোম্পানির প্রায় ৩ লাখ টাকা। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চাকরি আর সিসি ক্যামেরা লাগানোর ব্যবসা থেকে যে আয়-রোজগার হচ্ছিল, তার প্রায় সবই চলে যেত ঋণের সুদ দিতে। এসব কারণেই আত্মহত্যার পথ বেচে নেন তিনি।

কিন্তু এখন তার সংসারে উপার্জন করার কেউ নেই। প্রায় ৫ লাখ টাকার ঋণের বোঝা এসে পড়েছে পরিবারের ওপর। এই ঋণ শোধ করবেন কীভাবে তা নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন মিঠুনের মা শ্রীমতি রানী ও স্ত্রী বিউটি দাস।

মিঠুনের মা বলেন, ‘আমার আর কোনো ছেইলে নাই। ওর বাপে আগে ভ্যান চালাত। এখুন অসুস্থ হইয়ে পইড়ে আছে। মাথার ওপর এতগুলো ঋণ। আমার বাকি দিনডা চালিয়ে নিবে কে?’

স্ত্রী বিউটি দাস বলেন, ‘মঙ্গলবার শেষবার আমাকে ফোন করে বলেছিল, সে আছে চট্টগ্রামে। কাজে আছে। পরে কথা বলবে। আর কথা হলো না। কোনো দিন কথা হবে না।’ ‘এখন ঋণের বোঝা কে টানবে’ বলে নির্বাক হয়ে পড়েন।

এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে ফেসবুকে লাইভে এসে মিঠুন বলেন, ‘কোনো দিন ভাবিই নাই এ সিদ্ধান্ত নিব। এর আগে সিদ্ধান্তটা নিলে ক্ষতিটা হইত না। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’

‘ডিসেম্বর মাস থেকে বিপদ পিছু ছাড়ছে না। মা লক্ষ্মীও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কোম্পানির ৩ লাখ টাকার মতো হারাই ফেলছি। কেউ বিশ্বাসও করবে না। জানি আমার পরিবারটাকে দেখার কেউ নাই। কিন্তু এই মুখ নিয়ে মা-বাবাকে কীভাবে জানাব?’

একটু থেমে মিঠুন বলেন, ‘আমি চলে যাইতেছি। যারা আমার কাছ থেকে টাকা পান, ক্ষমা করে দিয়েন আমাকে। আমি আমার নিজের চোখে পরিবারটাকে শেষ হতে দেখতে পারি না।’

‘সরকারের কাছে একটাই আবেদন, পরিবারটাকে ঋণমুক্ত কইরেন, পরিবারটাকে বাঁচায়ে রাইখেন, শেষ হতে দিয়েন না। না ভালো স্বামী হইতে পারলাম, না ভালো সন্তান, না ভালো ভাই। মা-বাবা ক্ষমা করে দিও। বিউটিকে একটা ভালো ছেলে দেইখে বিয়ে করাই দিও। যারা টাকা পান, আমার পরিবারটাকে চাপ দিয়েন না। ওরা দিতে পারবে না।’

পরে গত বুধবার রাত ১টায় তার লাশ আসে রাজশাহী চারঘাটে। ওই রাতেই বাড়ির পাশে বড়াল নদের তীরে মিঠুনের মরদেহ সমাহিত করা হয়।

মিঠুনের মা জানান, ‘আগে শুধু সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজই করত মিঠুন। আগাম টাকা নিয়ে বাসায় কিংবা অফিসে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দিতেন। গত ডিসেম্বরে এভাবে নেওয়া দেড় লাখ টাকা এক বন্ধুকে দিয়েছিল সিসি ক্যামেরা কিনতে। ওই বন্ধু টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।’

‘তখন মিঠুন বাধ্য হয় ধারদেনা করে দেড় লাখ টাকার সিসি ক্যামেরা কিনে দিতে। এই ক্যামেরা লাগানোর সময় ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারেনি মিঠুন। ভুল করে বেশি ভোল্টে সংযোগ দিলে সব সিসি ক্যামেরা পুড়ে যায়। আবার ২ লাখ টাকা জরিমানা দিতে করা হয় ঋণ। এই এক কাজ করতে গিয়েই সাড়ে ৩ লাখ টাকা ঋণ হয়ে যায়।’

পরিবার সুত্রে জানা গেছে, মিঠুন দাউদকান্দিতে তিনটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ করেন। শ্রীমতি রানীও ননদের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ধার করে দেন। এ ছাড়া একটি সংস্থা থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দেন। ব্যবসার জন্য দাউদকান্দিতে সুদের ওপর ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন মিঠুন।

এ ছাড়াও চারঘাটে স্বর্ণকারের দোকানে গয়না বন্ধক রেখে শ্রীমতি রানীও ছেলেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এই ১ লাখ টাকার জন্য প্রতি মাসে হাজারে ১০০ টাকা হিসাবে মাসে ১০ হাজার টাকা সুদ দিতে হতো। কুলিয়ে উঠতে না পেরে ১০ হাজার টাকা বেতনে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন মিঠুন। কোম্পানির কালেকশন করা প্রায় ৩ লাখ টাকা বাসে চুরি হয়ে গেলে মানসিকভাবে মিঠুন ভেঙে পড়েন।