টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস আজ। একাত্তরের এই দিনে টাঙ্গাইলের অকুতোভয় বীর যোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে মুক্ত করেছিল প্রিয় মাটিকে। সেদিন বীর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাসে টাঙ্গাইল ছিল উল্লসিত। গৌরব গাঁথা এই দিনের জন্য টাঙ্গাইলবাসীকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য, স্বীকার করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ ও অবর্ণনীয় নির্যাতন। দীর্ঘ নয়টি মাস লড়তে হয়েছে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে।
বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের ভূমিকা এক অবিস্মরণীয় স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেই টাঙ্গাইলের বীর বাঙালি দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার প্রয়াসে সব প্রস্তুতি শুরু করে। গঠন করা হয় সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ- ওই সময় যা ‘হাই কমাণ্ড’ হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত ছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই কমিটি টাঙ্গাইল জেলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটির আদেশ-নির্দেশ মেনে চলবে।
২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রশাসন পরিচালিত হয়। ২৬ মার্চ সকালে আদালত পাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে এক সভায় গঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান ও আব্দুল কাদের সিদ্দিকীসহ আরও ৮ জনকে সদস্য করে কমিটি গঠিত হয়। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, গণপরিষদ সদস্য শামসুর রহমান খান শাজাহান ছিলেন অগ্রগণ্য। ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হবার পর চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইল শহর দখল করে।
গণমুক্তি পরিষদের উদ্যোগে একাত্তরের ২৬ মার্চ টাঙ্গাইল থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন এবং ২৭ মার্চ বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় টাঙ্গাইলে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে নামটি অতি উজ্জল হয়ে আছে, যার অংশগ্রহণে হাজার হাজার দামাল ছেলে সংগঠিত হয়েছিল দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে সেই কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৪০-৫০জন যুবক এবং কয়েকজন পুলিশ-আনসার ১৭ মার্চ রাতে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে প্রথম অপারেশনে অংশগ্রহণ করে। এই অপারেশনে দু’জন পাক সেনা অফিসারসহ ১৫০জন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দুই পাক সেনা অফিসার নিহত হয়।
২ এপ্রিল গণমুক্তি পরিষদ নেতারা জানতে পারেন ৩ এপ্রিল পাক বাহিনী টাঙ্গাইলে প্রবেশ করবে। পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার সংকল্প গ্রহণ করে হাইকমান্ড। প্রতিরোধের মূল কারণ তখন সড়ক পথে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার একমাত্র সড়ক ছিল ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক। পাকবাহিনীকে টাঙ্গাইলের প্রবেশ পথে প্রতিরোধ করতে পারলে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্নস্থান হানাদারমুক্ত রাখা যাবে। প্রতিরোধের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় মির্জাপুর থানার গোড়ান-সাঁটিয়াচড়া নামক এলাকা।
এখানে পাঁচটি পরিখা(বাংকার) খনন করা হয়। গড়ে তোলা হয় দু’টি প্রতিরোধ দূর্গ। ঢাকার বাইরে প্রথম এই প্রতিরোধ যুদ্ধে ২৩ জন ইপিআর সদস্যসহ ১০৭জন বাঙালি পাক বাহিনীর হত্যাকান্ডের শিকার হয়। পাকবাহিনী টাঙ্গাইলে প্রবেশ করলে গণমুক্তি পরিষদ ও হাইকমান্ড নেতৃবৃন্দ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ৩ এপ্রিলের প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে টাঙ্গাইলের ছাত্রজনতা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
২০ এপ্রিল থেকে ২ মে কাদের সিদ্দিকী গোপনে বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। ৪ মের মধ্যে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। টাঙ্গাইলের পাহাড়ি এলাকায় ক্যাম্প স্থাপনের এবং সেখানেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথম দিন কালিহাতী থানার মরিচায় শিবির স্থাপন করা হয়। সেখানে ১০জন মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হয়েছিলেন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত পাহাড়িয়া এলাকা সখীপুরের বহেড়াতলীতে চলে যান। সেখানে শুরু হয় এ বাহিনীর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এবং রিক্রুট ও প্রশিক্ষণ। পরবর্তীকালে এ বাহিনীরই নাম হয় ‘কাদেরিয়া বাহিনী’। এ বাহিনীর সদস্য ১৭ হাজারে উন্নীত হয়।
এ ছাড়া ১৮ হাজার সেচ্ছাসেবক বাহিনীও কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কাদেরিয়া বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া যখন চলছিল তখন টাঙ্গাইল জেলার অন্যান্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিবাহিনীর দু’একটি দল গড়ে ওঠে।
১২ মে কালিহাতীর বল্লায় পাক বাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১২ জুন কাদেরিয়া বাহিনী বল্লা আক্রমণ করে পাক বাহিনীকে নির্মূল করে দেয়। জুনের মধ্যেই কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইলের বিভিন্ন থানা আক্রমণ করে অস্ত্র সংগ্রহ করে। ১১ আগস্ট যমুনা তীরবর্তী ভূঞাপুরের মাটি কাটার যুদ্ধে ‘জাহাজমারা’ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী ৭টি স্টিমার ও লঞ্চে পরিবহণকৃত ২১ কোটি টাকা মূল্যের অস্ত্র অধিকার করে। এই আক্রমণে পাক সেনারা স্টিমার ছেড়ে স্পিডবোট যোগে পশ্চিমে সিরাজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়।
১৬ আগস্ট ঘাটাইলের মাকড়াইয়ে পাক বাহিনীর সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হাতেম নিহত এবং কাদের সিদ্দিকী আহত হন। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রায় পাঁচ হাজার পাক সেনা এবং সাত হাজার রাজাকার-আলবদর টাঙ্গাইলে অবস্থান করে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজিত করে খান সেনাদের। এসব যুদ্ধে ৩ শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৮ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়।
একের পর এক নাটিয়াপাড়া, নাগরপুর, চারান, করটিয়া, বাসাইল, ভূঞাপুর, ঘাটাইল, গোপালপুর প্রভৃতি স্থানে পাকবাহিনী পরাজিত হতে থাকে। তারা পালাতে শুরু করে রাজধানী ঢাকার দিকে। এ সময় কাদের সিদ্দিকী যোগাযোগ করেন মিত্রবাহিনীর সঙ্গে। মিত্র বাহিনীর ছত্রীসেনা অবতরণ করে টাঙ্গাইল শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে পৌলি সেতুর কাছে।
এখানে পাক বাহিনীর সঙ্গে মিত্র বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। শত শত পাক সেনা নিহত হয়। কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হয়। গ্রেপ্তার হয় অনেকে। এর মধ্যে জামালপুর হয়ে মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ক্লে এসে যোগ দেন। ১০ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের চারদিকে কাদেরিয়া বাহিনী অবস্থান নেয়।
এদিন রাতেই শহরের পশ্চিমে পোড়াবাড়ি দিয়ে কমান্ডার আবদুর রাজ্জাক ভোলা সহযোদ্ধাদের নিয়ে টাঙ্গাইলে প্রবেশ করে সদর থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ১১ ডিসেম্বর ভোরে পূর্বদিক দিয়ে প্রবেশ করেন কমাণ্ডার খন্দকার বায়েজিদ আলম ও খন্দকার আনোয়ার হোসেন, দক্ষিণ দিক দিয়ে আসেন ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান। আর উত্তর দিক থেকে ময়মনসিংহ সড়ক দিয়ে সাঁজোয়া বহর নিয়ে আসেন কাদের সিদ্দিকী।
শহরের কাছাকাছি এলে পাক সেনারা জেলা সদর পানির ট্যাঙ্কের উপর থেকে কাদের সিদ্দিকীর সাঁজোয়া বহরের ওপর গুলিবর্ষণ করে। পাল্টাগুলি গুলি ছোঁড়েন কাদের সিদ্দিকী। একে একে নিহত হয় সেখানকার সব পাকসেনা। বিজয়ীর বেশে টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করেন কাদের সিদ্দিকী। তার কাছে আত্মসমর্পণ করে সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাক সেনারা। সম্পূর্ণভাবে পাক হানাদারমুক্ত হয় টাঙ্গাইল। মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করে জেলাবাসী।


