আমরা ক্রমশ এক বিভাজনের সংস্কৃতি রচনা করে চলেছি। ঠিক এই লাইনটিই মনে এলো আমাদের বর্তমান সংস্কৃতি নিয়ে কিছু লিখবার প্রত্যাশায়।
আমাদের শিল্পীদের কোনো ধর্মীয় বৈষম্য, আর্থিক বৈষম্য, শিক্ষাগত বৈষম্যও থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আমরা শিল্পীরা রাজনীতিতে বিভাজিত, ধর্মে বিভাজিত, আর্থিক সিন্ডিকেটে বিভাজিত, এবং এলিট-নন এলিট সংস্কৃতিতে বিভাজিত।
এই বিভাজনটা কে তৈরি করল? তৈরি করেছে অপরাজনীতি! ধীরে ধীরে এর পচন হয়েছে। একদিনে এই পচন দেখা যায় না। বোঝাও যায় না। অপরাজনীতি চর্চার প্রথম ধাপ আসে শিক্ষাব্যবস্থাকে আঘাত করে।
ঐ ‘হীরক রাজার দেশে’ মুভিটার মতো। রাজা দেখলেন সমাজে তার প্রজারা শিক্ষিত হলে তাকে আর কেউ মানবে না। ফলে ইশকুলে যাওয়ার আর দরকার নেই... এইসব বয়ান দিতে লাগলেন।
অনেকে ভাবতেই পারেন। সংস্কৃতির পচনের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্কটা আবার কী? বিরাট সম্পর্ক। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বারোয়ারি পদ্ধতি এবং সমন্বয়হীনতা, অটো পাস কিংবা প্রচুর পাসের হার দেখানোর প্রতিযোগিতায় আমরা আমাদের বিনাশ ঘটিয়ে ফেলেছি। ফলে সার্টিফিকেটধারী হতাশাগ্রস্ত বেকার তৈরি হয়েছে প্রচুর, কিন্তু শিক্ষিত নাগরিক হয়ে ওঠেনি।
এ কারণেই ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেছে আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির কৌলীন্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পকেটে অর্থ কম। কিন্তু তারা শিক্ষা-সংস্কৃতিতে যে উচ্চ আসনে, সেই গৌরব তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। সেই আত্মমর্যাদা শেষ হয়ে গেছে। আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগেও সমাজে শিক্ষিত মুরুব্বি কোনো মফস্বলের ফাংশনে প্রধান অতিথির চেয়ারে বসত। আজ সেখানে বসছেন আর্থিক যোগানদাতা কোনো এক ধনকুবের অশিক্ষিত এবং আনকালচারড কেউ। তিনি তার মতো ভুলভাল বয়ান পেশ করছেন।
এই যে প্রধান অতিথির চেয়ারের মানুষটাকে আমরা বদলে ফেললাম। ঠিক তখনই সামনের দর্শকেরা দেখা শুরু করতে লাগল... নেতা তো টাকা দিয়েই হইছে। তা হলে আমিও যে কোনো উপায়ে অর্থে বিত্তশালী হইলেই সংস্কৃতির মুরুব্বি হইতে পারব। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ বানানো নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে স্রোতের অনুকূলে থাকা রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন চান শিল্পীরা। তাদের এই মনোনয়ন প্রত্যাশাটা দেশপ্রেম নাকি অতি লোভ?
এই প্রত্যাশা তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও গ্রাস করে ফেলে। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভুলপথে বেড়ে ওঠে। তারা আর গান, কবিতা, সাহিত্যের চর্চার প্রতি কোনো আগ্রহ এবং সম্মান দেখানোর প্রয়োজন মনে করে না।
তাই ২৫ বছর আগের কোনো ক্যাসেট কাভারের ডিজাইন দেখলে আমরা অবাক হই। এত নান্দনিকতা! অথচ প্রযুক্তির আড়ম্বর বেড়েছে। আমরা আরও বিকৃত হয়েছি।
গানের নব্বই দশকে যে আধুনিক ও রক গানের রেভুলেশন সেটির উত্থান-পতন এই দুইটিই আমাদের প্রজন্ম দেখেছে।
তাই আমরা বলতে পারি আমরা রুচিবদলের যে গর্বিত স্মর তা আমরা হারিয়ে ফেলেছি দিনকে দিন।
সিনেমাতেও আমরা এখনো নিজস্ব কালচার তৈরি করতে ব্যর্থ! আমরা নিজেদের সত্ত্বা থেকে সরে এসেছি। জহির রায়হান, তারেক মাসুদ, আলমগীর কবির, সুভাষ দত্ত তারা তাদের ছবিতে বাংলাদেশ দেখাতেন। বাংলাদেশের কালচার দেখাতেন। কিন্তু না! তারা হয়ে গেলেন বিকল্প ধারার নির্মাতা। ঢিসুম ঢিসুম মারপিট আর গান কোরিয়ান কিংবা তামিল, বলিউড স্টাইলটা বাংলাদেশে এডাপ্ট করা সেই ফর্মুলা ছবি হয়ে উঠল মেইনস্ট্রিম। ফলে আমাদের আর নিজস্ব ধারার ছবি বলতে কিছু থাকল না।
আজকের পৃথিবীতে হংকংয়ের মুভির একরকম প্যাটার্ন। ওরা শৈশব থেকে কারাতে শেখে সেটাই তাদের কালচার। সিনেমাতেও তাই দেখায়। কিংবা তামিল মুভিতে তাদের খাদ্যাভ্যাস, নাচ, মদ্যপান থাকে, ইরানি মুভিতে ওদের নিজস্ব জীবন আমরা দেখতে পাই, তেমনি থাকে আমেরিকান হলিউড মুভিতেও। কিন্তু আমাদের মুভির নিজস্ব কোনো ব্যাকরণ আজো অব্দি স্থায়িত্ব পেল না। এর ফলে আমাদের মুভি না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায়।
নেটফ্লিক্স, প্রাইম এমাজন থেকে শুরু করে বিশ্বের বড় বড় ওটিটি প্লাটফর্মগুলো নাইজেরিয়ান, নেপালি এমনকি ইন্দোনেশিয়ান মুভি মেকারদের টাকা দিচ্ছে তাদের নিজস্ব ঘরানার ছবি বানানোর জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের এত এত মুভি দর্শক থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব ওটিটি প্লাটফর্মে আমরা জায়গা পাচ্ছি না। কারণ আমাদের নিজস্ব সত্ত্বা অশিক্ষিত শ্রেণির কাছে বর্গা দিয়ে ফেলেছি।
বলতে পারেন এখানে আবার শিক্ষাব্যবস্থা টানার কী দরকার। দরকার আছে? কারণ ওই যে বললাম- আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। বা করে দেওয়া হয়েছে। তারা কোনো কালচারের প্রতি আর প্রাত্যাহিক রুটিনে আর অভ্যস্ত না। তাদের মাসে একবার মুভি দেখার জন্য মন টানে না। বইয়ের লাইব্রেরিতে অল্প দামে সদস্য হওয়া যায়, কিন্তু তাদের সেখানে টানে না। বরং চড়া মূল্যের বুফে ডিনার আমাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্তরা নিয়মিত হাজির।
তাই এখন হিরো আলমের ভিউ হয় কয়েক মিলিয়ন, আবার জনপ্রিয় কোনো তারকার ভিউ তার সমান বা তার চেয়ে খানিক কম। কিন্তু অভিনয় আর কাজের মানের দিকে কিন্তু মূলধারার শিল্পীদের পরিশ্রম ও খরচ বেশি। মূল্যায়ন!
এ ছাড়া দেখবেন লাকী আখন্দর নিজের কম্পোজিশনে তার গাওয়া গানের ভিউ ২০ হাজার। ভুল সুরে গাওয়া নতুন কারো গানের ভিউ ২৫ লাখ। এখন আমরা কী তাকে লাকী আখান্দর চেয়েও বড় মাপের শিল্পী বলব? তা নিশ্চয়ই না।
কিন্তু সবচেয়ে বড় অসহায়ত্বের জায়গা হলো এই যে ভুলভাল কালচার কে দেখছে, কে তাদের ভিউ দিচ্ছে? সমাজের একদল অশিক্ষা। যা দীর্ঘদিন ধরে অপরাজনীতি রাষ্ট্রের সংস্কৃতি নষ্ট করে এক উদ্ভট শ্রেণি তৈরি করেছে। ফলে ৩০ বছর আগের বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এখনকার চেয়ে অনেক আধুনিক ও রুচিশীল।
এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর আর নিচে থাকা নিম্নবিত্ত যাদের অধিকাংশ সমাজের বিপথগামী, কিংবা মৌলিক চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত। আরেক স্তর উচ্চবিত্ত। যারা বাংলাদেশে থাকেন ঠিকই, কিন্তু লাইফস্টাইলের কোনো কিছুতেই বাংলা সংস্কৃতি নেই।
নাম না উল্লেখ করে একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। সম্প্রতি এক জনপ্রিয় চিত্রনায়কের সন্তানকে জিজ্ঞেস করলেন সাংবাদিক, সে তার বাবার কোন ছবিটি একাধিকবার দেখেছে। সে কোনো কথাই বলতে পারছে না। এবং পরে তার মা সাংবাদিককে বললেন ও ঠিকমতো বাংলাটা বলতে পারে না। বাবার মুভি দেখবে কী করে। এই যে নিজের পেশার প্রতি, নিজের সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞাÑ বিশাল একশ্রেণির।
সেই মায়ের গর্বিত স্মর যে ‘ছেলে আমার বাংলা বলতে পারে না’ এই গর্বস্মর রাষ্ট্রের জন্য লজ্জা। অথচ পুরো একটা শ্রেণি তার পরিবারকে বাংলার কাছ থেকে দূরে রেখে গর্ববোধ করছে।
আসলে ‘দেশপ্রেম’টা কী? দেশের জন্য প্রেম। আপনি দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ তুলবেন। বিশ্বের যেখানেই থাকুন না কেন বুকের ভেতরে আপনার বাংলাদেশটা থাকলেই তা কোনো না কোনোভাবে দেশের কাজে লাগে। আমাদের আশাবাদের জায়গা হলো আমাদের দেশে এখনো দেশপ্রেমিকের সংখ্যা নেহায়েত কম না। তাই এই সমাজব্যবস্থা আজো টিকে আছে। শুধু লুটেরা রাজনীতিবিদরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা রুগ্ন করে এক অন্তসারশূন্য প্রজন্ম তৈরি করেছে। যে প্রজন্ম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে অযথা অকারণে ফেসবুক, রিলস বা টিকটক দেখে। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতির বৈকল্য এমন একটা জায়গায় ঠেকেছে, যে বিভিন্ন এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ নামের একটি প্রজাতি তৈরি হয়েছে। যাদের আদতে কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই নাই। তাদের গণমাধ্যম বলছে ‘তারকা’। আমি এদের গৌণমাধ্যম বলি।
শুধু পেজ-এ মিলিয়ন ভিউ আছে বলে পুরস্কার প্রদানের মঞ্চে এমন এমন মানুষের সঙ্গে আপনি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, যে সমাজ তখন বিভ্রান্ত হয়। সামনে বসে থাকা সদ্য ঢাকা নগরীতে আসা মেয়েটি তখন ভাবেÑ আমি কেন কষ্ট করে গল্প কবিতা লিখব? বা নাচ অভিনয় শিখব? আমি কেন গান শিখব? আমি সারাদিন মেকাপ করে টিকটক করে পেজ-এ ফলোয়ার বাড়ালেই আমি সমাজে সেরা স্বীকতজন।
ফলে অন্ধের হাতে কুড়াল দিয়ে আমরা বন উজাড় করে ফেলছি।
এই বিভ্রান্ত ঘুচবে তখনই। যখন একদল শিক্ষিত শ্রেণি এদেশের সংস্কৃতিকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে। তা হয়তো দূর অস্ত! কিন্তু এটাকেও রুখতে অপরাজনীতির অবসান দরকার। কারণ আমরা কেউই রাজনীতি বা রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।


