ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

চট্টগ্রাম বন্দর: আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত

আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৫, ০৯:০০ পিএম
ছবি- সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বন্দর দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নীরব চালিকাশক্তি। বিশ্ববাণিজ্যের গতিশীলতা আজ এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে—যেখানে দ্রুততা, প্রযুক্তি ও আঘাতসহনশীল অবকাঠামো ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। এমন প্রেক্ষাপটে এনসিটি ও সিসিটি পরিচালনায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অংশীদার যুক্ত করার প্রস্তাব মূলত বাংলাদেশের বন্দরব্যবস্থাকে আধুনিক অর্থনীতির মানচিত্রে পুনর্গঠনের একটি বড় সুযোগ।

বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে, শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে হলে শুধু উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়; বরং নিশ্চিত করতে হবে দ্রুত ও নিরাপদ সরবরাহব্যবস্থা। চট্টগ্রাম বন্দরকে এ রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার অন্যতম উপায় হলো দক্ষ অপারেশনাল ব্যবস্থাপনা। আন্তর্জাতিক অপারেটর যুক্ত হলে সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে—ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং সংকট মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি। বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা এখন নানা ধরনের ভূরাজনৈতিক চাপ, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সমুদ্রগামী রুটের অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ অপারেটরের প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমকে আরও স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য করে তুলতে পারে।

বন্দর উন্নয়নকে সাধারণত কেবল লজিস্টিক সুবিধা বা বাণিজ্য সম্প্রসারণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো—বন্দর একটি দেশের সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশের মুখচ্ছবি। যখন একটি দেশের প্রধান বন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়, তখন বিনিয়োগকারীরা সেই দেশকে আরও নিরাপদ, দক্ষ ও প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ শুধু বন্দর বা লজিস্টিক খাতে সীমাবদ্ধ থাকে না; ব্যাংকিং, প্রযুক্তি, পর্যটন, রিয়েল এস্টেট এবং শিল্পাঞ্চল—সব খাতেই নতুন বিনিয়োগ প্রবাহ তৈরি হয়। এটি অর্থনীতির বহুমুখীকরণ ঘটায় এবং জাতীয় আয়ে স্থায়ী স্থিতিশীলতা আনে।

বাংলাদেশের রপ্তানি গতি ধরে রাখতে হলে বন্দরকেন্দ্রিক সাপ্লাই চেইনকে শক্তিশালী করা এখন অত্যাবশ্যক। তৈরি পোশাক থেকে ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ থেকে প্লাস্টিক—প্রতিটি রপ্তানি খাতই সময়সাপেক্ষ অপারেশনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুত কার্গো হ্যান্ডলিং এবং উন্নত লজিস্টিক সাপোর্ট পেলে উদ্যোক্তারা আরও বড় পরিসরে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবেন। এর পাশাপাশি রপ্তানিকারকেরা সময়মতো পণ্য পাঠাতে পারলে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে—যা দেশের ব্র্যান্ড ইমেজ উন্নত করবে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপারেটরদের অংশগ্রহণ প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা জোরদারে বড় ভূমিকা রাখবে। বিশ্ববন্দরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন সাইবার আক্রমণ, টার্মিনালের স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমে হ্যাকিং এবং পণ্য জালিয়াতি। এসব মোকাবিলায় উন্নত নিরাপত্তা সফটওয়্যার, স্মার্ট ট্র্যাকিং সিস্টেম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মনিটরিং এবং স্বয়ংক্রিয় ঝুঁকি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা প্রয়োজন—যা আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে বিদ্যমান। চট্টগ্রাম বন্দরে এই প্রযুক্তিগুলো চালু হলে দেশের বাণিজ্য কার্যক্রম আরও নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে।

যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি ওঠে—শ্রমিকদের কী হবে? রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে বাস্তবতা হলো, দক্ষতার মূল্য কখনো কমে না। বরং নতুন প্রযুক্তি, উন্নত যন্ত্রপাতি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মান শিখে নেওয়ার মাধ্যমে দেশীয় শ্রমিকরা আরও বেশি চাকরির সুযোগ ও উচ্চ বেতন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেন। বিশ্বের আধুনিক বন্দরগুলোতে শ্রমিকদের ভূমিকা কখনো কমেনি, বরং তাদের কাজের ধরন ও গুরুত্ব আরও বেড়েছে। তাই শ্রমিকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন—এই অংশীদারিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে রাখা হলে তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে।

বন্দর উন্নয়নকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক অর্থনীতিও বড় ধরনের গতি পাবে। চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রদ্বার। মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে বাণিজ্য প্রবাহ বাড়াতে হলে বিশ্বমানের টার্মিনালের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ যদি এ সুযোগ কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর আঞ্চলিক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠবে—যার প্রতিটি সুবিধা সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।

সুতরাং, এনসিটি ও সিসিটি পরিচালনায় অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক অংশীদার যুক্ত করার সিদ্ধান্তটি মূলত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এখানে ঝুঁকি অবশ্যই আছে, কিন্তু সুস্পষ্ট নীতিমালা, কঠোর তদারকি, শ্রমিকবান্ধব কাঠামো এবং চুক্তির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে সম্ভাবনার পরিসর আরও অনেক বড়। বন্দর কেবল দেশের বাণিজ্য নয়, বরং জাতীয় সক্ষমতার প্রতীক। সেই সক্ষমতাকে বিশ্বমানের পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোই হবে যথার্থ পথ।

চট্টগ্রাম বন্দর আজ নতুন সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে। সময় এসেছে সাহসী সিদ্ধান্ত, সঠিক কৌশল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।