বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে, তখন সমুদ্রবন্দরগুলোর আধুনিকীকরণ এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যপথে বাংলাদেশের অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দেশের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ গত দেড় দশকে এত দ্রুত বেড়েছে যে বর্তমান বন্দর কাঠামোকে সম্প্রসারণ ছাড়া বিকল্প নেই।
এমন বাস্তবতায় গত মাসে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ডেনিস কোম্পানির ৩০ বছর মেয়াদি বন্দর ব্যবস্থাপনা চুক্তি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে এ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি শুধু অর্থনীতির গতি প্রবাহই নয়, আঞ্চলিক কূটনীতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও নতুন মাত্রা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—এই চুক্তি দেশের জন্য কতটা লাভজনক এবং ক্ষতির সম্ভাবনা কতটুকু? এটিই আমার আলোচনার বিষয়।
দেশের অর্থনীতির সদর দরজা খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দর গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত বন্দর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সূচকে বন্দরটি প্রতিবছরই জাহাজজট, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় চাপের মুখে পড়ছে।
চট্টগ্রামের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আমদানি-রপ্তানির খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে মোংলা ও পায়রার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে সেগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় পৌঁছাতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়াতে হলে বন্দরের টার্নঅ্যারাউন্ড সময় কমাতে হবে, কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়াতে হবে, এবং সেবার মান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। এসব বিবেচনায় বন্দর পরিচালনায় বিদেশি দক্ষতা কাজে লাগানো বিশ্বব্যাপী একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
এই প্রেক্ষিতে ডেনিশ কোম্পানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি মূলত বন্দর উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও আধুনিকীকরণে দীর্ঘমেয়াদি একটি কাঠামো তৈরি করেছে। চুক্তিটি অনুযায়ী বন্দর ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কন্টেইনার টার্মিনালের সম্প্রসারণ, লজিস্টিক পরিষেবার মানোন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানের অপারেশনাল ব্যবস্থাপনা আশা করা হচ্ছে।
সরকার দাবি করছে—এই চুক্তি বন্দরের সক্ষমতা ৩০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে, যা দেশের রপ্তানি শিল্পকে বিশেষ করে তৈরি পোশাক, চামড়া, ওষুধ, নৌযান ও কৃষিজাত পণ্যখাতে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।
শুধু তাই নয়, দেশের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন যে বন্দরের অদক্ষতা, অযাচিত জট, কাগজপত্রের জটিলতা এবং চাঁদাবাজি আমদানি-রপ্তানির খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ কারণে তাদের মতে, যদি আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি ও প্রশাসনিক দক্ষতা যুক্ত হয়, তবে সরবরাহ শৃঙ্খলা দ্রুততর হবে এবং বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা বাড়বে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিক্স পারফরম্যান্স ইনডেক্সে পিছিয়ে আছে; বন্দর উন্নয়নের মাধ্যমে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে দেশের আন্তর্জাতিক সুনামও বাড়বে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশ চুক্তির বিরোধিতা করছে।
তাদের আশঙ্কা—এত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে, পাশাপাশি আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে। বিরোধী দলগুলো এ-ও বলছে যে বন্দর পরিচালনার মতো জাতীয় স্বার্থসম্পন্ন খাতে বিদেশি কোম্পানিকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া ভবিষ্যতে দেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থাকে জটিল করে তুলতে পারে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার উদাহরণ টেনে তাঁরা বলছেন—অতিরিক্ত নির্ভরতা বা অস্বচ্ছ চুক্তি একসময় রাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে পারে।
কিন্তু এই সমালোচনার পেছনে যে অন্য এক বাস্তবতা রয়েছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে বন্দরকে আধুনিকীকরণ করার বিকল্প নেই, আর বাংলাদেশের বন্দরগুলো যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দ্রুত উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও দক্ষতার একটি সমন্বিত কাঠামো দরকার, যা বিদেশি অংশীদারিত্ব ছাড়া অনেকটাই কঠিন। আর ড্যানিশ কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক বন্দর ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ একটি প্রতিষ্ঠান। সুতরাং দক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাওয়ার যুক্তি অস্বীকার করা যায় না।
চুক্তির বিরোধিতার আরেকটি অঘোষিত উদ্বেগ হলো রাজনৈতিক প্রভাব কমে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে বন্দরে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিছু অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রতিযোগিতাহীন প্রভাব বিস্তার, নিয়োগ-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা একটি স্বাভাবিক চিত্র।
বিদেশি কোম্পানি স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনায় চললে এইসব অনিয়ম কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিরোধিতার পেছনে তাই রাজনৈতিক প্রভাব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট যুক্তি সঙ্গত কারণ আছে। কারণ বন্দরগুলো ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক ক্ষেত্র—যেখানে প্রভাব খাটানোর সুযোগ থাকলে তা রাজনীতিকে শক্তিশালী করে। অতএব, স্বচ্ছ বন্দর পরিচালনা যত বাড়বে, রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহারের সুযোগ তত কমবে।
অন্যদিকে খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে বাংলাদেশে কনটেইনার টার্নঅ্যারাউন্ড সময় দক্ষিণ এশিয়ার গড় মানের তুলনায় বেশি। এর ফলে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয়। উন্নত ব্যবস্থাপনা এলে যদি সময় কমে, খরচ কমে, এবং আমদানি-রপ্তানি দ্রুত হয়—তাহলে এটি দেশের অর্থনীতির জন্য বড় সুবিধা। রপ্তানিনির্ভর বাংলাদেশে সরবরাহ শৃঙ্খলা দ্রুত হওয়া মানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখা। ফলে ব্যবসায়ীরা এই চুক্তিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন।
কূটনৈতিক বাস্তবতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বর্তমানে বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতির ওপর দাঁড়িয়ে। ভারত–চীন–জাপান–যুক্তরাষ্ট্র সবাইই বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে চায়। সমুদ্রবন্দরগুলো তাই শুধু বাণিজ্যের পথ নয়—এগুলো সামরিক কৌশল, বাণিজ্য নিরাপত্তা এবং জোট-রাজনীতিরও অংশ। বাংলাদেশ যদি দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তার বন্দরগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে পারে, তাহলে দেশটি আঞ্চলিক ট্রানজিট হাব হিসেবে উন্নীত হতে পারে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও ইতিবাচক।
তবে সামরিক কৌশলের দিক থেকে স্বচ্ছতা অত্যন্ত জরুরি। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি মানেই সামরিক নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া নয়। বন্দর ব্যবস্থাপনা বেসামরিক, আর নিরাপত্তা রাষ্ট্রের হাতে থাকে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্পষ্ট করেছে যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি সরকারের অধীনেই থাকবে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বেসরকারি কোম্পানি শুধুই বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করে, নিরাপত্তা নয়।
সমুদ্র বন্দর চুক্তির ফলে বাংলাদেশ সরাসরি কিছু সুবিধা ভোগ করবে যেমন-আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াদ্রুততর হবে।জাহাজজট কমবে। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বাড়বে।কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।আন্তর্জাতিক সুনাম বাড়বে। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ব্যবসায়ীদের জন্য খরচ কমবে। এবং বন্দর ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও প্রযুক্তি আধুনিক হবে।
বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্রবন্দরগুলো দক্ষ না হলে দেশের বাণিজ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। তাই আধুনিকীকরণের পথ এড়িয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তবে উন্নয়ন যেন সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ না করে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
সুতরাং সমুদ্রবন্দর চুক্তির লাভ-ক্ষতি নির্ধারণের চাবিকাঠি হচ্ছে রাষ্ট্রের বিচক্ষণতা। যদি চুক্তিটি স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয়, যদি জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে, এবং যদি বন্দরগুলো প্রতিযোগিতামূলক মানে পৌঁছে—তাহলে লাভই বেশি।
শেষ কথা:
বাংলাদেশের উচিত বাস্তবতার আলোকে এগিয়ে যাওয়া—আবেগ নয়, যুক্তি; প্রতিহিংসা নয়, উন্নয়ন; এবং রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। ইতিহাস বলছে—যে দেশ সমুদ্রবন্দরগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে, সেই দেশই অর্থনীতিতে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশও সেই সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে। সুতরাং আমাদের বন্দরনীতি কি হবে—এ সিদ্ধান্ত এখন বাংলাদেশের।
লেখক:সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা।
-20251203211233.webp)




