বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুধু মানবিক বিপর্যয় নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট। ২০১৭ সালের পর থেকে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী জনপদে পরিণত করেছে কক্সবাজার অঞ্চলকে। অস্থায়ী মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কমে আসা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত তীব্র হওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব—সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলছে।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি দিন দিন উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর প্রভাব, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান, মানবপাচার এবং খুন–অপরাধ বৃদ্ধি পুরো অঞ্চলের স্থিতি নষ্ট করছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (ARSA) ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি ক্যাম্পকে পরিণত করছে ‘রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্রে’। এসব কার্যকলাপ বাংলাদেশকে নতুন নিরাপত্তা ব্যয়ের মুখে ফেলেছে, বিশেষ করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপ অত্যন্ত প্রকট। কক্সবাজারসহ পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি—কৃষিজমি দখল হয়ে যাওয়া, শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, স্থানীয় বাজারে মূল্য অস্থিতিশীলতা, বন উজাড়, পরিবেশ দূষণ এবং জ্বালানি-কাঠ সংকট এসবই স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও এত বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটানো কঠিন। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে এলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
আঞ্চলিক কূটনীতি এই সংকট সমাধানে এখনও প্রত্যাশিত গতি পায়নি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা স্পষ্ট অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কেউই চাপ সৃষ্টিতে কার্যকর নেতৃত্ব দিচ্ছে না। চীন-ভারত—এই দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ মিয়ানমারের জান্তার ওপর কম-বেশি নির্ভরশীল, ফলে তারা শক্ত অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত। ফলাফল—রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, আর বাংলাদেশকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শরণার্থী বোঝা বইতে হচ্ছে।
তবে এই সংকটকে অনন্তকাল ধরে চলতে দেওয়া যাবে না। সমাধানের পথ সুস্পষ্ট এবং তা তিনটি স্তরে কার্যকর হতে পারে—দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক।
প্রথমত, দেশীয় কাঠামো শক্তিশালী করা অপরিহার্য। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করতে হবে, অপরাধচক্র ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে হবে। তথ্য–প্রযুক্তি ব্যবহার, বায়োমেট্রিক নিবন্ধন, নজরদারি ক্যামেরা, এবং ক্যাম্প পরিচালনায় বেসামরিক–সামরিক সমন্বয় আরও জোরদার করা উচিত। একইসঙ্গে স্থানীয় জনগণের জন্য বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি—নতুন কর্মসংস্থান, পরিবেশ পুনর্বাসন এবং অবকাঠামোগত সহায়তা—নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রোহিঙ্গা উপস্থিতির কারণে তারা বঞ্চনার শিকার না হন।
দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক কূটনীতিকে আগের চেয়ে আরও দৃঢ় ও কৌশলগত হতে হবে। বাংলাদেশের উচিত ভারত, চীন, থাইল্যান্ড এবং আসিয়ানের সঙ্গে সমন্বিত আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর প্রত্যাবাসনের চাপ বজায় রাখা। মানবিক সংকটকে আঞ্চলিক নিরাপত্তাহুমকি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলে বৃহৎ শক্তিগুলোরও সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়বে।
মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে সরাসরি ও ধারাবাহিক সংলাপ বজায় রেখে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেফ জোন’ বা আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষিত প্রত্যাবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা নতুন করে সক্রিয় করা অত্যন্ত প্রয়োজন। জাতিসংঘ, ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, ওআইসি—সবাইকে যৌথভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন তহবিল গঠন করা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য–দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প চালু রাখা এবং পুনর্বাসনের আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। একইসঙ্গে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে মানবপাচার ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিস্তার রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের সৃষ্টি নয়; বরং মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের জাতিগত বৈষম্য, দমননীতি ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ফল। তাই এ সংকটের ন্যায়সঙ্গত সমাধানও বহুপক্ষীয় ও টেকসই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে; এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব—রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বাস্তব পথ নিশ্চিত করা।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আজ কেবল একটি শরণার্থী সংকট নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ এক পরীক্ষা। সময় এসেছে সব পক্ষকে নতুন করে ভাবার—এই সংকট সমাধান ছাড়া অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও স্থিতি অধরাই থেকে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

