বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হলো বেসরকারি খাত, আর এর অগ্রভাগে রয়েছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (FBCCI)। দীর্ঘদিন ধরে FBCCI দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে এবং এর বর্তমান পরিসেবাগুলোও যথেষ্ট প্রশংসনীয়।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, FBCCI-এর উচিত তার বিদ্যমান কাঠামো এবং সেবাকে আরও উন্নত ও কার্যকর করা যাতে এটি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অদ্বিতীয় ‘ওয়ান-স্টপ সলিউশন’-এ পরিণত হতে পারে। এখানে মূল লক্ষ্য নতুন কিছু তৈরি করা নয়, বরং যা আছে তাকেই আরও শক্তিশালী, আধুনিক এবং সদস্য-কেন্দ্রিক করে তোলা।
একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্পপতি পর্যন্ত, প্রত্যেকেরই ব্যবসায়িক যাত্রায় নানা ধরনের তথ্য, পরামর্শ এবং সহায়তার প্রয়োজন হয়। FBCCI-এর মতো একটি বৃহৎ সংগঠন ইতোমধ্যেই তথ্যকেন্দ্র, বিশেষজ্ঞ পরামর্শসেবা, বিরোধ নিষ্পত্তি এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই কার্যক্রমগুলোকে আরও বেশি ফলপ্রসূ করে তোলা যায়, যাতে প্রতিটি ব্যবসায়ী তার প্রয়োজনীয় সমাধান দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পেতে পারেন?
FBCCI-এর তথ্যকেন্দ্র নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেবা। এটিকে আরও কার্যকর করতে একটি অত্যাধুনিক, ব্যবহারবান্ধব অনলাইন পোর্টাল এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন হিসেবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে, যেখানে সমস্ত তথ্য সহজলভ্য থাকবে। এটি শুধুমাত্র সরকারি নীতি, আইন, বিধিমালা বা শুল্কসংক্রান্ত তথ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের অর্থনৈতিক সূচক, বিভিন্ন খাতের বিস্তারিত গবেষণা প্রতিবেদন, বাজার প্রবণতা, বিনিয়োগের সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির সর্বশেষ আপডেটও অন্তর্ভুক্ত করবে।
এছাড়াও, সদস্যদের ব্যবসার ধরন ও আগ্রহ অনুযায়ী ব্যক্তিগতকৃত (personalized) তথ্য ও অ্যালার্ট প্রদানের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন পোশাক প্রস্তুতকারক যেন বস্ত্র খাতের নতুন নীতিমালা বা রপ্তানি সুযোগ সম্পর্কে সরাসরি নোটিফিকেশন পান। তথ্যের সহজলভ্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত অনলাইন লাইভ প্রশ্নোত্তর (Q&A) সেশন আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
FBCCI-এর বিশেষজ্ঞ পরামর্শসেবা একটি দারুণ উদ্যোগ, এবং এটিকে আরও বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় করা সম্ভব। শুধু আইনি বা আর্থিক পরামর্শেই সীমাবদ্ধ না রেখে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, সাইবার নিরাপত্তা, পরিবেশগত সম্মতি, সাপ্লাই চেইন অপটিমাইজেশন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির মতো বিষয়েও বিশেষজ্ঞ প্যানেল অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের দ্বারা নতুন বা উদীয়মান উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সুসংগঠিত মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।
পাশাপাশি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, আইটি, পর্যটন বা ফিনটেকের মতো নির্দিষ্ট খাতের জন্য বিশেষায়িত কর্মশালা ও পরামর্শ সেশন আয়োজন করা উচিত যা সংশ্লিষ্ট খাতের সুনির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
FBCCI-এর সালিশি ও মধ্যস্থতা কেন্দ্রকে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ রয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত ও কম ব্যয়বহুল করা অত্যাবশ্যক, যাতে ব্যবসায়ীরা আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে পারেন। এক্ষেত্রে অনলাইন বিরোধ নিষ্পত্তির (Online Dispute Resolution – ODR) পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। মধ্যস্থতাকারীদের জন্য নিয়মিত উচ্চতর প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রাম চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা আরও জটিল বিরোধ নিষ্পত্তিতে সক্ষম হন।
এই কেন্দ্রের সুবিধাগুলো সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো দরকার, যাতে আরও বেশি ব্যবসায়ী এই সেবার প্রতি আস্থাশীল হন এবং এটি ব্যবহার করতে উৎসাহিত হন যা ব্যবসায়িক সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।
FBCCI-এর প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান, এবং এটিকে আরও প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর করা সম্ভব। ই-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) মতো আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতার উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করা, যা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সহায়তা করবে, সেটিও অপরিহার্য।
এছাড়াও, ব্যবসায়ীদের সময় এবং প্রয়োজন অনুসারে অনলাইন ‘অন-ডিমান্ড’ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যা তাদের কাজের ফাঁকে শিখতে সাহায্য করবে তা একটি যুগোপযোগী সংযোজন হতে পারে।
সর্বোপরি, FBCCI সফলভাবে নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট আয়োজন করে থাকে, তবে এটিকে আরও ফলপ্রসূ করা সম্ভব। একটি শক্তিশালী ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা উচিত, যেখানে ব্যবসায়ীরা অনলাইনে একে-অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে এবং সম্ভাব্য ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজে পেতে পারেন।
শুধু সাধারণ ট্রেড ফেয়ার নয়, নির্দিষ্ট শিল্প বা থিমভিত্তিক (যেমন: সবুজ শিল্প, ফিনটেক) সম্মেলন ও ইভেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে আরও লক্ষ্যভিত্তিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলা যেতে পারে।
বিভিন্ন দেশের চেম্বার অব কমার্স এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্ব জোরদার করা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের নতুন দ্বার উন্মোচন করবে এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণে সহায়ক হবে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিও হবে আরও চাঙা ও গতিশীল।
আপনার মতামত লিখুন :