দেশের ব্যাংকখ্যাতকে লুটে-পুটে খাওয়া এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দুর্নীতির ঘটনা ঘটে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে।
৬ শতাধিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় সরাসরি তৎকালীন চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে, যার অনুমোদন নেওয়া হয়নি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও। গত বছরে ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় অনিয়মতান্ত্রিক নিয়োগ পাওয়াদের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা হিসেবে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এরপর থেকেই ব্যাংকটিকে অচল অবস্থায় ফেলতে ষড়যন্ত্র করছে চাকরিচ্যুত কর্মীরা। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে অবস্থিত প্রধান কার্যালয় আল-আরাফাহ টাওয়ারের সামনে টানা ৬ কার্যদিবস আন্দোলনে বেহাত হচ্ছে ব্যাংকিং কার্যক্রম।
এ ঘটনায় গত রোববার ডিএমপির পল্টন মডেল থানায় আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পক্ষে হেড অব লিগ্যাল এ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের মো. আবু মুশা সাধারণ ডায়েরি(জিডি) করেন। যদিও পুলিশ এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী নাসিরুল আমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়ারা ব্যাংককে কর্তৃপক্ষকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন- এমন অভিযোগে জিডি করা হয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি, তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।
ব্যাংকটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। নিয়োগ বাণিজ্য, নিয়ম না মেনে নিয়োগ এবং চাহিদার তুলনায় বেশি নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটে অনেক।
এমনকি ৬ শতাধিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় সরাসরি তৎকালীন চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে, যার অনুমোদন নেওয়া হয়নি ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকেও। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন তদারকি সংস্থার তদন্তে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন অসঙ্গতি সামনে চলে আসে।
বিষয়টি নিয়মের মধ্যে আনার লক্ষ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর অংশ হিসেবে চিহ্নিত ১৪১৪ কর্মকর্তার মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর মধ্যে অকৃতকার্য ৫৪৭ জনকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এই চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা গত ২৮ জুলাই সকালে আকস্মিকভাবে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের হেড অফিসের প্রবেশমুখে জড়ো হয়ে মানবঢাল তৈরি করে এবং মারমুখী আচরণ করতে থাকে। এরপর থেকে টানা ৬ দিন ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা একইভাবে প্রধান গেট বন্ধ করে রেখেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর নয়াপল্টনে থাকা এস আলম গ্রুপের গ্যালকো অফিস থেকে আন্দোলনকারীদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। ঢাকায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে টাকার জোগান দেওয়া হচ্ছে। তাদের মিশন অনির্দিষ্টকালের জন্য আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় অচল করে রাখা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্যান্য ব্যাংকগুলোর চাকরিচ্যুত সদস্যরাও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। এদেরকে সংঘবদ্ধ করে পেছন থেকে আরও উসকে দিচ্ছেন আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ লাবুর পিএস মোহাম্মদ পিয়ারু।
আন্দোলনরত অধিকাংশ চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছিলেন এই পিয়ারুর তত্ত্বাবধানে। ক্যাশ অফিসার পদে ১২ লাখ এবং অফিসার পদে ১৫ লাখ করে নিয়ে পিয়ারুর মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার বিষয়টি ছিল সবার মুখে মুখে।
তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ লাবু তার পিএস মোহাম্মদ পিয়ারুকে এমন ক্ষতাবান বানিয়েছিলেন যে, এমডি থেকে শুরু করে সবাই তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। স্বাভাবিক চাকরি জীবনে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা যেখানে ২৫ বছরে একটি পদে পৌঁছান, পিয়ারুকে মাত্র পাঁচ বছরেই সেই পদে পৌঁছে দেওয়া হয়।
মূলত ব্যাংকের নেপথ্য চেয়ারম্যানে পরিণত হন পিয়ারু। ব্যাংকের এমন কোনো বিভাগ বা কাজ ছিল না যেখানে পিয়ারু নাক গলাননি। এ নিয়ে সবার মধ্যে চরম ক্ষোভ থাকলেও কেউ টু শব্দ করার সাহস পাননি। পটপরিবর্তনের পর বর্তমান ম্যানেজমেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ পিয়ারুকে চাকরিচ্যুত করেছে। কিন্তু এখনো তার অদৃশ্য প্রভাব রয়েছে ব্যাংকে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন কিছু নতুন মুখ আসছে আল-আরাফাহ টাওয়ারের সামনে। এখনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর কোনো নির্দেশনা না আসায় আন্দোলনকারীদের সরাতে পুলিশ কোনো শক্তি প্রয়োগ করেনি। তবে তাদের অবস্থান ও গতিবিধির উপর তীক্ষè নজরদারি করা হচ্ছে।
ভুক্তভোগী এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, চাকরিচ্যুতরা আমাদের কাউকে অফিস করতে দিচ্ছে না। তারা বলপ্রয়োগ করে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। শত শত কর্মীর কর্মক্ষেত্রকে তারা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন না করে গুরুতর অপরাধ করা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হাজার হাজার কর্মীর ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এর আগেও আরও চারটি ব্যাংকের কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। কিন্তু চাকরিচ্যুতরা এভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাদের শক্ত হাতে মোকাবেলা করা হয়েছে। তবে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মানবিকভাবে সামলানোর চেষ্টা করছেন, যাতে বাস্তবতা বুঝে বিক্ষুব্ধরা ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু ঘটনার পেছনে এখন কিছু গ্রুপ কাজ করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
এদিকে চাকরিচ্যুতদের দাবি, তাদের কোনো নোটিশ না দিয়ে অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। চাকরি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এ বিষয়ে ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ঘোষণা দিয়ে তাদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। যথাযথ বিধান মেনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে কোনো রকম বিতর্ক তোলার সুযোগ নেই। এ সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি রাষ্ট্র সম্পৃক্ত। এখানে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এককভাবে কিছু করার নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দুর্নীতি করা হয়েছে। নির্দিষ্ট একটি এলাকার লোকজনকে যাচাই-বাছাই ছাড়া সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে সারা দেশের মেধাবীরা বঞ্চিত হন।
দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এভাবে চাহিদার অতিরিক্ত ঝাঁকে ঝাঁকে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা এর আগে ঘটেনি। এখন এই চাকরিচ্যুতদের মানবিক দিক সামনে এনে গোটা ব্যাংকিং সেক্টরকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে গোটা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও যথাযথ পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে বলেও তিনি জানান।
আপনার মতামত লিখুন :