ক্যালেন্ডারের পাতায় ফিরে এলো জুলাই। বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পাল্টানো স্মরণীয় এক মাস। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নেমেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একদল শিক্ষার্থী। স্ফুলিঙ্গের মতো সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। আন্দোলন থামাতে সব শক্তি প্রয়োগ করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেই দমন-নিপীড়ন আর বন্দুকের নলের মুখে বুক পেতে দাঁড়ায় বাংলার তরুণরা। একপর্যায়ে সেই আন্দোলন আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল না।
স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। সেই গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে স্বৈরাচার, বৈষম্য আর নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা নিয়ে জুলাই গণআন্দোলন হয়েছিল সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ হলোÑ এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এক বছরের মাথায় এসে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা পুরোপুরি পূর্ণ না হলেও দেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন এসেছে। তবে গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ থাকত, তাহলে দেশে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি হতো।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামে অরাজনৈতিক ছাত্র প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথমদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগরসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন হলেও পরবর্তী সময়ে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আন্দোলন দমাতে পুলিশ, ছাত্রলীগসহ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোও আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে রাস্তায় নামে। শেষমেশ ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করেন তৎক্ষালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে বৈষম্যের প্রতিবাদে বিভিন্ন দল-মতের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে আন্দোলন করলেও গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এসে তাদের মধ্যে দেখা দেয় বিভক্তি। বিতর্কে জড়িয়েছেন অনেক নেতাও। আবার শক্তিশালী সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। সংগঠনটি ছেড়েছেন অধিকাংশ শীর্ষ নেতাই। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা দেশে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে একাধিক রাজনৈতিক দলও ঘোষণা করেন। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ) অন্যতম। তবে এনসিপিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ নেতারা থাকায় দলটি ইতিমধ্যে সারা দেশে বেশ সাড়া ফেলেছে।
এদিকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হলেও এখনো দেশের নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়ে গেছে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এখনো সব জায়গায় অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য দূর হয়নি। বন্ধ হয়নি হয়রানি, নির্যাতন, খুন, রাহাজানি। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ও ভোটাধিকার সংস্কারের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে জুলাইয়ের আকাক্সক্ষা পুরোপুরি পূর্ণ না হওয়ায় এবং জুলাই অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্মকে ঘিরে নানা নৈরাজ্য ও বাণিজ্য হওয়ায় হতাশায় আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকেই। তারা জুলাই আন্দোলনের শক্তি বেহাত হচ্ছে বলেও মক্তব্য করছেন। সর্বশেষ নানা অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমাও। উমামার সব অভিযোগ ফেলে দেওয়ার মতো না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি বলেন, উমামা ফাতেমা যেসব অভিযোগ তুলেছেন, তার মধ্যে সব অভিযোগ ফেলে দেওয়ার মতো না। আবার সব গ্রহণ করার মতোও না।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বার্তা ও আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে এবং সর্বজনীন মতৈক্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনসহ মোট ১১টি কমিশন গঠিত হয়। এসব সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যেই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের আলোকে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠন করতে ইতিমধ্যেই সিরিজ বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের এসব বৈঠকে কোনো কোনো বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হচ্ছে, কোনোটিতে ঐকমত্য পৌঁছাতে পারছে না রাজনৈতিক দলগুলো।
অন্যদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো ঘোষণা করা হয়নি জুলাই ঘোষণাপত্র। উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা থাকলেও সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে গতকাল এককভাবে ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা জানায় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, শহিদ, আহত ও নেতৃত্বদের অবদান ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা এবং জুলাইয়ের আকাক্সক্ষার সংজ্ঞায়ন নিশ্চিতে একটি জাতীয় দলিল যা পরবর্তী সময়ে আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি পাবে। গত ৩১ ডিসেম্বর ছাত্রনেতৃত্ব জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে সরকারিভাবে ঘোষণাপত্র দিতে চেয়েছিল। ছাত্রনেতৃত্ব তাই তাদের উদ্যোগ থেকে সরে এসেছিল। সরকার যদি কোনো উদ্যোগই না নেয় আমরা বসে থাকব না। আমাদের বক্তব্য, আমাদের ইশতেহার অবশ্যই আমরা প্রকাশ করব।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ গত বোরবার ‘জুলাই সনদ’ কবে নাগাদ হতে পারে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেছেন।
সার্বিক বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই অভুত্থান হয়েছিল বলেই আমরা পরিবর্তনের আলোচনা করতে পারছি। পরিবর্তন, সংস্কারের বিষয়ে স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করতে পারছি। যদিও গণমানুষের প্রাপ্তির যে আশা ছিল সত্যিকার অর্থে সে স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে সবগুলো দল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একরুমে বসে আলোচনার সুবিধা পেত না, যদি জুলাই অভ্যুত্থান না হতো।
দলটির আরেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তুহিন মাহমুদ জানান, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে মানুষ যে আকাক্সক্ষা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, সেই আশা এখনো পূরণ হয়নি। আহতরা আজও হাসপাতালের বেডে আর্তনাদ করছে, শহিদ পরিবারের পুনর্বাসন হয়নি। সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সচিবালয়ে এখনো ফ্যাসিস্টদের সহযোগীরা দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একটা স্বৈরতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা থেকে বের হয়ে নতুন শাসনব্যবস্থার দিকে গেছে। মানুষ নানা বিষয়ে কথা বলতে পারছে। যদিও আমরা অন্তর্বর্তীকালীন পিরিয়ডে আছি। আমাদের গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নির্বাচন। সরকার নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার শেষ করতে পারলে সরকারের সফলতা আসবে।
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের অনেক প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে। আবার অনেক প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। তবে এখনো ‘মোটা দাগে’ জুলাই আন্দোলন তার পথ হারায়নি। কিন্তু কিছু কিছু ব্যত্যয় হয়েছে। এই ব্যত্যয়গুলো না থাকলে জুলাই আন্দোলনে আরো অনেক সাফল্য থাকত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিম বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, স্বাধীনভাবে কথা বলা, ভোটাধিকার প্রদান করা, প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করার প্রত্যাশা ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সেই আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। আলাপ-আলোচনা আর কথাবার্তায়ই ৯-১০ মাস পেরিয়ে গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যেসব দল-মতের মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে এখন দূরত্ব আরো বেড়েছে। অনেকেই হতাশা প্রকাশ করছেন। যদিও এখনো সময় আছে। আমরা আশা করব, সব স্টেকহোল্ডার একমত হয়ে জুলাই ঐকমত্যের একটা ঘোষণা দেবে।